বিষেই (কীটনাশক) শেষ হতে চলেছে সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি। বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা ম্যানগ্রোভ এ বনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার থামছেই না। শুধু পূর্ব সুন্দরবন বিভাগেই গত চার মাসে বিভিন্ন অভিযানে জেলেদের আটকসহ বিষের বোতল ও বিষ দিয়ে আহরণ করা বিপুল পরিমাণ মাছ জব্দ করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, কিছু ব্যক্তি অবৈধ পথে ভারতীয় এ কীটনাশক আমদানি করে জেলেদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের তথ্যমতে তালিকাভুক্ত ৫ হাজার ৮০০ জেলে সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের অনুমোদিত নদী-খালে পাস নিয়ে মাছ ও কাঁকড়া আহরণ করে থাকেন। সুন্দরবনের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ হলেও দাদনের জালে আটকে থাকা অধিকাংশ জেলে লোকালয়ে তাদের মহাজন ও আড়তদারদের সরবরাহকৃত বিষ খালের পানিতে ছড়িয়ে দিয়ে মাছ আহরণ করেন। মহাজন ও দাদনদারদের চাপেই দরিদ্র জেলেরা অধিক মাছ প্রাপ্তির আসায় বিষ দিয়ে মাছ ধরেন। গত জুন থেকে সেপ্টেম্বর চার মাসে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে আড়াই শ অভিযানে ১৩২ অপরাধীকে আটক করেছেন বনরক্ষীরা। জেলেদের কাছ থেকে এ সময় জব্দ করা হয়েছে ৪৫টি বিষভর্তি বোতল, ৪ কেজি বিষ পাউডার (যার প্রায় প্রতিটিতেই মেড ইন ইন্ডিয়া লেখা), ৬৫৭ কেজি বিষযুক্ত মাছ। বিষ দিয়ে ধরা ২২ বস্তা শুঁটকি মাছ, ৩৭৫ কেজি কাঁকড়া, ২৪২টি ট্রলার ও নৌকা, প্রায় ২০ হাজার ফুট জাল আটক করা হয়। মোংলা উপজেলার জয়মণি এলাকার রণজিৎ ম ল নামে এক জেলে জানান, সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রামগুলোর বেশির ভাগ জেলে মহাজনের দাদনের জালে আটকানো। অনেক সময় বাধ্য হয়েই তাঁরা বিষ দিয়ে মাছ শিকার করেন।
সুন্দরবন নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, বিষ দিয়ে মাছ শিকারে শুধু সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদই নয়, বনের পানি ভয়াবহভাবে দূষিত হয়ে ডলফিনসহ জলজ প্রাণী, পাখি, বন্যপ্রাণী ও ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছের শ্বাসমূলও চরম হুমকির মুখে পড়েছে। বিষ দিয়ে আহরণ করা মাছ খেয়ে মানুষের স্বাস্থ্যও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।
বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘হরিণ শিকার ও বিষ দিয়ে মাছ ধরা ঠেকাতে আমরা ইতোমধ্যে ড্রোন ব্যবহার শুরু করেছি। এতে হরিণ শিকারিদের কার্যক্রম কমে এসেছে। তবে বিষ দিয়ে মাছ ধরা এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়ে সয়লাব হয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ এ বিষ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কৃষি বিভাগের। ইতোমধ্যে আমরা কৃষি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, যাতে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় কীটনাশক ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করা যায়।’
বাগেরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মোতাহার হোসেন বলেন, ‘মোংলা ও শরণখোলা উপজেলায় কীটনাশক বিক্রি করা ডিলারদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ দুই উপজেলায় তালিকাভুক্ত প্রায় ৪০ জন কীটনাশক বিক্রেতা রয়েছেন। যেসব ডিলার অবৈধ পথে ভারতীয় কীটনাশক আমদানি করছেন, বাড়িতে মজুত করছেন, সুন্দরবনের জেলে, আড়তদার ও মহাজনদের কাছে বিক্রি করছেন তাদের শনাক্ত করে কীটনাশকের লাইসেন্স বাতিল করা হবে।’