গণজোয়ার সাধারণত রাজনৈতিক বিষয়ে বলা হয়। এমন জোয়ারের রেকর্ড অনেক দেখা যায়। ফুটবল বা কোনো খেলা কেন্দ্র করে কখনো কি গণজোয়ার লক্ষ করা গেছে? এটা ঠিক, বিভিন্ন খেলায় গ্যালারিতে উপচে পড়া দর্শকের সমাগম ঘটেছে। কিন্তু বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ফুটবল ম্যাচে যে উন্মাদনা ও গণজোয়ারের দেখা মিলল তা অতীত রেকর্ডকেও হার মানাল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মারদেকা কাপের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলেছে। এর আগে ১৯৭২ সালে ভারতের বিখ্যাত ক্লাব মোহনবাগান ঢাকা সফরে এসেছিল। ঢাকা একাদশের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলে ০-১ গোলে হেরে যায় তারা। ওই ম্যাচেও উপচে পড়া দর্শকের সমাগম ঘটেছিল।
বাংলাদেশের খেলাধুলার ইতিহাসে ফুটবল ঘিরেই উন্মাদনাটা বেশি দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে দেশের জনপ্রিয় দুই ক্লাব মোহামেডান ও আবাহনীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। সত্তর ও আশির দশকে দুই দলের ম্যাচ ঘিরে গ্যালারিতে দর্শক উপচে পড়ত। জায়গা না পেয়ে হাজার হাজার দর্শককে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে হতো। শুধু তাই নয়, গ্যালারিতে জায়গা না পেয়ে তারকাঁটা ডিঙিয়ে দর্শক মাঠে নেমে সারিবদ্ধভাবে বসে খেলা উপভোগ করত। কত মধুর ও বেদনার স্মৃতি জড়িয়ে আছে দুই দলের ম্যাচে। সত্তর, আশি বা নব্বইয়ের দশকে আবাহনী-মোহামেডানের ম্যাচে উপচে পড়া দর্শক হলেও ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে স্মরণকালের সেরা দর্শকসমাগম হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। সেবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল এশিয়া কাপ হকি। ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান ও ভারত। ওই ম্যাচ দেখতে ঢাকার বাইরে থেকেও লোক এসেছিল। হকিতে তখন ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনা ছিল অন্য রকম।
ওই ফাইনালে গ্যালারিতে ঢুকতে লাইন ছড়িয়ে পড়ে নবাবপুর রোড পর্যন্ত। গ্যালারিতে জায়গা না পেয়ে মাঠের দুই পাশে হাজার হাজার দর্শক বসে খেলা দেখে। দর্শকের উত্তেজনায় মাঝেমধ্যে খেলা বন্ধ রাখতে হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে আগা খান গোল্ডকাপ ফাইনালেও স্মরণকালের সেরা দর্শকসমাগম ঘটে। তবে তা এশিয়া কাপের মতো নয়। ১৯৮৮ সালে এশিয়া কাপ ক্রিকেট ফাইনালেও প্রচুর দর্শক হয়। ১০০ টাকার টিকিট কালোবাজারে বিক্রি হয়েছিল ১০০০ টাকায়।
তবে সব ইতিহাস ছাপিয়ে গেছে বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচ। টিকিটের মূল্য বড় অঙ্কের হলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সোল্ডআউট; যা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিরল ঘটনা। ঢাকার মাঠে অনেক আন্তর্জাতিক ফুটবল হয়েছে। মেসি, ডি-মারিয়াদের মতো বিখ্যাত ফুটবলার তৎকালীন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে খেলে গেছেন। আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়ার ম্যাচ দেখতে দর্শক হয়েছে। তবে বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুরের ম্যাচের মতো উত্তাপ ছড়ায়নি। একে উত্তাপ বললেও ছোট করা হবে। বলতে হবে এ এক ইতিহাস।
সত্যিই দেশের ফুটবলে নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি হলো; যা কখনো ভাবা যায়নি। শিলংয়ে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ শেষ হওয়ার পরই আলোচনা শুরু হয় কবে ঢাকার মাঠে হামজা দেওয়ান চৌধুরীকে দেখব। তবে গতকাল গ্যালারিতে স্থানসংকুলান না হলেও দর্শক মাঠে নেমে খেলা দেখেনি। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। কিন্তু ম্যাচ ঘিরে যে উন্মাদনা ছড়িয়েছে তা অতীত ইতিহাস ডিঙিয়ে গেছে। যদি হামজা, সামিত সোম বা ফাহামিদুলরা না খেলতেন তাহলে কি এমন ঘটত? তখন হয়তো অনেকে খবরই রাখতেন না।
১৯৭৩ সালেই তো বাংলাদেশ জাতীয় দলের অভিষেক। কত তারকা খেলেছেন ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশে। কখনো হেসেছেন, কখনো কেঁদেছেন। ৫২ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের ফুটবল অন্য রূপ ধারণ করেছে বলেই গণজোয়ার নেমে এসেছে। ইংল্যান্ড, কানাডা, ইতালির প্রবাসীরা মাতৃত্বের টানে বাংলাদেশে খেলছেন বলে ফুটবলে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। গতকাল ম্যাচ হেরেছে বাংলাদেশ। তবু ফুটবলে অন্যরকম দিন পার করল। যা অনেক দিন পর দেখা গেল।