বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত ভাসুবিহার। এটি বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর একটি। এ স্থানটি স্থানীয়দের কাছে নরপতির ধাপ নামে বেশ পরিচিত। এ প্রত্নস্থল মূলত অষ্টম শতকের বৌদ্ধ বিহার। তবে ব্রিটিশ আমলে ভাসুবিহারকে স্থানীয় মানুষ ‘ভুশ্বুবিহার’ নামে আখ্যায়িত করেছেন; যা বর্তমানে ভাসুবিহার নামে পরিচিত। যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রায় ৭০০ বৌদ্ধভিক্ষু, ধর্মশাস্ত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতেন। ঐতিহাসিক এ স্থানটি দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে। ভাসুবিহার বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার এবং বগুড়া সদর থেকে উত্তরে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে ও মহাস্থানগড় থেকে ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে বিহার বন্দরের কাছে নাগর নদের তীরে অবস্থিত। বগুড়া শহর থেকে সিএনজিযোগে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ টাকা ভাড়ায় সহজে যাওয়া যায় ভাসুবিহারে। ভাসুবিহার ছাড়াও ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ে আরও অনেক কিছু রয়েছে। এখানে রয়েছে মহাস্থান প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘর, দুধপাথর, হজরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী মাহিসওয়ার (রহ.)-এর মাজার, প্রধান শিষ্যের মাজার, লাহোর পীর সাহেবের মাজার, হজরত মীর বোরহান উদ্দীন (রহ.)-এর মাজার, বারানসি বিল, কাটা দুয়ার, বেহুলার বাসরঘর, পদ্মদেবীর বাড়ি, মহাস্থান রেস্ট হাউস, জিউৎ কুপ ও গোবিন্দ ভিটা। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে এখানে এসেছিলেন। তার ভ্রমণ বিবরণীতে তিনি এটাকে ‘পো-শি-পো’ বা বিশ্ববিহার নামে উল্লেখ করেছেন। এটি বৌদ্ধদের ধর্মীয় বিদ্যাপীঠ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৭৩-৭৪ সালে ভাসুবিহারটির প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ শুরু হয়। পরবর্তী দুই মৌসুম তা অব্যাহত থাকে। খনন কাজের ফলে দুটি মধ্যম আকৃতির সংঘারাম ও একটি মন্দিরের স্থাপত্যিক কাঠামোসহ প্রচুর পরিমাণ প্রত্নবস্তু উন্মোচিত হয়। অপেক্ষাকৃত ছোট সংঘারামটির আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৪৯ মিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে ৪৬ মিটার। এর চার বাহুতে ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য ২৬টি কক্ষ ও কক্ষগুলোর সামনে চারপাশে ঘোরানো বারান্দা এবং পূর্ব বাহুর কেন্দ্রস্থলে প্রবেশপথ রয়েছে। বৃহদাকার বিহারটির ভূমি পরিকল্পনা ও স্থাপত্য কৌশল প্রথমটির অনুরূপ। এর পরিমাপ পূর্ব-পশ্চিমে ৫৬ মিটার ও উত্তর-দক্ষিণে ৪৯ মিটার। এর চার বাহুতে ৩০টি ভিক্ষুকক্ষ এবং দক্ষিণ বাহুর কেন্দ্রস্থলে প্রবেশপথ অবস্থিত। বিহারের অদূরে উত্তরমুখী মন্দিরটির আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৩৮ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ২৭ মিটার। মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটি বর্গাকার মণ্ডপ। এর চারদিকে রয়েছে ধাপে ধাপে উন্নত প্রদক্ষিণ পথ। খননে প্রাপ্ত প্রায় ৮০০ প্রত্নবস্তুর মধ্যে ব্রোঞ্জের ক্ষুদ্রাকৃতির মূর্তি, পোড়ামাটির ফলক এবং পোড়ামাটির সিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া সংগৃহীত হয়েছে মূল্যবান পাথরের গুটিকা, লোহার পেরেক, মাটির গুটিকা, নকশাকৃত ইট, মাটির প্রদীপ ও অন্যান্য দৈনন্দিন ব্যবহার্য দ্রব্যাদি এবং প্রচুর মৃৎপাত্রের টুকরো। মূর্তিগুলোর মধ্যে বুদ্ধ, ধ্যানীবুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব এবং বোধিশক্তি উল্লেখযোগ্য। প্রাপ্ত মূর্তির দীর্ঘ হালকা-পাতলা শরীর, ক্ষীণ কটি, প্রশস্ত বুক এবং মার্জিত অন্যান্য বৈশিষ্ট্য পালযুগের ধ্রুপদি শিল্পকলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিহারটিতে মূল তিনটি স্থাপত্য ছিল। এর মধ্য দুটি বৌদ্ধদের ধ্যানের জন্য ব্যবহার করছিলেন ও একটি বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত ছিল। আর অন্যটি ছিল প্রার্থনার জন্য।
এ ছাড়া খননকালে ২৫০টির বেশি অক্ষর খোদিত সিল পাওয়া গেছে। যার মধ্যে এ পর্যন্ত ১০০টির বেশির পাঠোদ্ধার করা হয়েছে। ভাসুবিহারে ইট অলংকরণে পদ্মের পাপড়ি এবং ধাপ-পিরামিড বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানে ভাসুবিহারে এসে মূর্তির দেখা না মিললেও পর্যটকরা এসে ঘুরে দেখেন বিহার আর মন্দিরের অস্তিত্ব। উল্লেখ্য, বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউন সাঙ (সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগ) তাঁর ভ্রমণ বিবরণীতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি মহাস্থানগড় থেকে চার মাইল দূরে একটি মঠ দেখেছিলেন। এছাড়া তৎকালীন শ্রীলঙ্কার হাইকমিশনারের মেয়ের বিয়ে এই বিহারেই হয়েছিল। এদিকে মহাস্থান গড় একটি ঐতিহাসিক পটভূমি। গড়ের পূর্ব পাশে মহাসড়ক। মহাসড়কের অনতিদূরে কৃত্রিম মাটির পাহাড়। এই পাহাড়ই বর্তমান মহাস্থান গড় নামে অভিহিত। মহাস্থান গড়ের প্রাচীন নাম ছিল বরেন্দ্র বা পুন্ড্র নগর। এই গড় বা দুর্গ এককালে মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন রাজাদের রাজধানী ছিল। মৌর্য এবং গুপ্ত রাজারা কত বছর রাজত্ব করেছিলেন তা সঠিক বলা দৃঢ়। তবে পাল রাজারা এখানে রাজত্ব করেন ৭৫০ থেকে ১১২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণ সেন যখন গীড়ে রাজত্ব করতেন তখন মহাস্থান গড় ছিল অরক্ষিত। মহাস্থান বাসস্ট্যান্ডের অদূরে পশ্চিমে হজরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখীর (রা.) মাজার অবস্থিত। সুলতান বলখী আফগানিস্তানের অন্তর্গত বলখী প্রদেশের পরাক্রান্ত একজন রাজা ছিলেন। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সুলতান বলখীর মনে এক সময় ভাবান্তর হয়। যার ফলে তিনি রাজকার্য পরিত্যাগ করে দামেস্ক শহরে এক কামেল পীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এখানে তিনি ১২ বছর, মতান্তরে ৩৬ বছর আধ্যাত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করে ইসলাম প্রচারের জন্য বাংলাদেশে আগমন করেন।