প্রাচ্যের এক বিস্ময় চীন। হাজার বছরের ইতিহাস আর আধুনিকতার মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা এই দেশ যেন উন্নয়ন, শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যের অনন্য উদাহরণ। রাজধানী বেইজিং শহরের প্রতিটি সড়ক পরিচ্ছন্ন, যানবাহন চলে নিয়ম মেনে। লোকজন সময়নিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল। পার্কে দেখা যায়, প্রবীণদের ব্যায়াম, শিশুদের খেলা আর তরুণদের হাসিমুখ। চীনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য তার বৈচিত্র্য। বিশাল এই দেশে পাহাড়, নদী, মরুভূমি সমুদ্র সবই আছে। শহর থেকে গ্রাম, সবখানেই উন্নয়নের ছোঁয়া, রয়েছে প্রকৃতির সৌন্দর্য ও মানুষের আন্তরিকতা...
প্রায় ১৪৫ কোটি মানুষের দেশ চীন। রাজধানী বেইজিং। বিশাল বিশাল চওড়া সড়ক, এপার থেকে ওপারে যেতে লেগে যায় এক মিনিট। সবুজ সিগন্যাল বাতি জ্বললে পথচারীরা এপার-ওপার হচ্ছেন। রাস্তায় চোখ ধাঁধানো রঙের বাস, ট্যাক্সি এবং বাইকগুলো তখন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকছে। লোক পারাপার না হলেও ওগুলো লাল বাতি না জ্বলা পর্যন্ত দাঁড়িয়েই থাকবে। কোনো হর্ন নেই, যান্ত্রিক শব্দ নেই। শব্দ না থাকার কারণ, এখানে যা কিছু আছে সব চলে বিদ্যুতে।
রাজধানী বলে কথা, লোকজনের ব্যস্ততা বা হুড়োহুড়ি থাকাটাই আমরা স্বাভাবিক বলে জেনেছি। কিন্তু বেইজিংয়ে এসব নেই। হাতেগোনা কিছু মানুষ চোখে পড়ে যারা খুব ধীরেসুস্থে চলছেন। কাউকে পাশ কাটিয়ে চলার প্রবণতা নেই। চোখে পড়ে ঝকঝকে ট্যাক্সি, ২-৪টি বাস (তার ভিতর যাত্রীও ৭-৮ জনের বেশি নয়)। আছে অনেক মোটরসাইকেল এবং হরেক রকম সাইকেল। এগুলো সব চলে বিদ্যুতে। এসবেরও হর্ন নেই, শব্দ নেই। সবই চলে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে। পথে কোনো পুলিশ বা ট্রাফিকও নেই। গোটা রাস্তা এবং অলিগলি সবখানে অসংখ্য সিসি ক্যামেরা রয়েছে। সব আছে নজরদারিতে। একেকটি ক্যামেরা পোস্টে অন্তত ৫-৭ সারি করে সিসি ক্যামেরা লাগানো। সারিগুলোর এক-একটিতে কম করে ক্যামেরার সংখ্যা ৮-১০টি। সব ধরা পড়ে ক্যামেরায়। ফলে অনিয়মের কোনো রকম সুযোগ নেই। আর এখানকার মানুষ সে সুযোগ খোঁজেনও না। তারা এই অটোমেটিক সিস্টেমেই অভ্যস্ত। রাস্তা, মার্কেট, হোটেল, শপিংমলগুলোতে নজর রাখা বা প্রয়োজনীয় নানা কাজ করার জন্য লোকজন নেই বললেই চলে। তার বদলে আছে রোবট। এগুলো দিব্বি মানুষের মতো চলাচল করছে। এদিক-ওদিক ঘুরে দেখছে, নজর রাখছে। কয়েকটা রোবটের সঙ্গে কথা বলারও চেষ্টা করেছি। কথা বললে, রোবটগুলো কী যে বলে, তা বুঝতে পারিনি। তবে ছবি তুলতে বাধা দেয়নি এগুলো।
চীনের মানুষ তো চীনা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলেন না। এমনকি আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিও বলেন না, শেখেন না, বোঝেন না। নিজের ভাষা, কৃষ্টি এবং নিজের দেশের জিনিসপত্র ছাড়া তারা অন্য কোনো দেশের কিছু ব্যবহার করেন না। নিজেদের দেশপ্রীতি এবং ভাষাপ্রীতির এমন নজির আর কোথাও আছে কিনা জানি না। এ কারণে কথা চালাচালি করতে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। খাবার নিয়েও পোহাতে হয় ঝক্কি। কারণ ওরা যা খায়, তা আমরা খাই না, খাওয়ার কথা ভাবতেও পারি না।
বেইজিং ঘুরে মনে হয়েছে আর যাই-ই পরিবর্তন ঘটুক দেশটিতে এখনো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা চালু আছে। এখানে কোনো ধনী-গরিব ব্যবধান নেই। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। পোশাক-আশাক এবং জীবনযাপনে কোনো ব্যবধান বা দারিদ্র্যের চিহ্ন নেই। বরং সব কিছুতে অকল্পনীয় আভিজাত্য দেখেছি। এ গেল একটা চিত্র। বেইজিংয়ের যে কোনো রাস্তা বা জায়গায় দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালে যে দৃশ্য দেখা যায়, তা রীতিমতো তাক লাগানো। মনে হয় দৃশ্যগুলো বাস্তব নয় একেকটি রঙিন ছবি। শহরজুড়ে সুউচ্চ রঙিন অট্টালিকার সারি। এসবের নির্মাণনৈপুণ্য দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়, মন ভরে যায়। এক-দুই কিলোমিটার দূরে দূরে রয়েছে ক্লান্তি কাটানো বা মানসিক প্রফুল্লতার জন্য নানা ব্যবস্থা। রয়েছে বড়সড় পার্ক। যেখানে আনন্দ বা নৃত্যের জন্য চীনা মিউজিক বাজছে। দেখলাম সেই মিউজিকের তালে তালে বয়স্ক বা বুড়োবুড়িরা হাতে হাত ধরে দলে দলে নাচছেন। পার্কে রয়েছে দোলনা, হাতের ব্যায়ামের ব্যবস্থা, পায়ের ব্যায়ামের ব্যবস্থাসহ নানা কিছু। প্রচুর গাছপালায় ছাওয়া এই স্থানগুলোতে দিনরাত শুয়ে বসে কাটালেও ক্লান্তির দেখা মিলবে না। জেনেছি, গোটা বেইজিং নগরী এমনকি চীন দেশ জুড়েই শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার এমন ব্যবস্থা রয়েছে। ধারণা ছিল চীনে বুঝি গাছাপালা কম। না তা নয়। অনেক গাছাপালা এখানে। দিনরাত এসব গাছের যত্ন করা হচ্ছে। এজন্য নিয়োজিত রয়েছে লোকজন। বেইজিংয়ে অবস্থান করছিলাম সপ্তাহখানেকের বেশি সময়। ১৪ অক্টোবর বেইজিংয়ের তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলেও পরদিন থেকে তা নামতে নামতে ৬ ডিগ্রিতে পৌঁছে। এটা দুপুর পর্যন্ত হিসাব। তারপর তাপমাত্রা রাতে একেবারে শূন্য ডিগ্রি ছাড়িয়ে মাইনাসে নেমে আসে। সন্ধ্যার পর আমাদের জন্য বাইরে বেড়ানো একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তবে চীনারা এ তাপমাত্রায় পুরোপুরি অভ্যস্ত। ভয়ংকর শীতকে তাদের কিছুই মনে হচ্ছে না। তারা স্বাভাবিকভাবেই চলাচল করছে।
ঘুরেছি ঐতিহাসিক তিয়ান আনমেন স্কয়ার, ফরবিডেন সিটি (নিষিদ্ধ নগরী), গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ, টেম্পল অব হেভেন, চীনের জনক মহান নেতা মাও সে তুংয়ের বিভিন্ন স্মৃতি স্থান, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং মেট্রো ট্রেনে করে শত শত কিলোমিটার।