বাংলাদেশের ফুটবলে বসুন্ধরা গ্রুপ পরিচালিত ক্লাব ‘বসুন্ধরা কিংস’ শুরু থেকে পেশাদারি কার্যকলাপকে সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়ে ঘরোয়া ফুটবলে অন্যতম শক্তিশালী ক্লাব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। প্রিমিয়ার লীগ খেলতে নেমে গত ছয় মৌসুমের মধ্যে একটানা পাঁচবার শিরোপা জিতে শুধু দেশের ফুটবলে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি নয়, কল্যাণময়ী আবেদন এবং প্রভাবও সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। এই বিষয়টিকে ফুটবলসংশ্লিষ্ট কেউ কেউ বাঁকা চোখে দেখেন বা তাঁরা ঈর্ষান্বিত হয়ে ক্লাবটির সাফল্য ও অবদানকে হেয় প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে সব সময় চেষ্টা করেন যুক্তিহীন এবং মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে ক্লাবের ভাবমূর্তিকে আঘাত করতে। কেউ ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে জড়িত, কেউ ক্লাব সংগঠক, সাবেক খেলোয়াড় কিংবা তথাকথিত ফুটবল বিজ্ঞরা বুঝতে অপারগ, এখন যে সময় চলছে, মতলব হাসিলের জন্য বিরুদ্ধাচরণ করে ‘পাবলিককে গেলানোর’ চেষ্টায় কামিয়াব হওয়া মুশকিল।
মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। তারা তো শুধু দেশের ফুটবল নয়, বাইরের ফুটবলের সঙ্গেও পরিচিত এবং ওয়াকিফহাল। বাংলাদেশ জাতীয় দল আগামী ৬ ও ৯ সেপ্টেম্বর দুটি ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলবে নেপালে। জাতীয় দলের হেড কোচ ক্যাবেরা কিন্তু আগে বলেছিলেন পেশাদার লীগ কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে যে এই ‘উইন্ডোতে’ বাংলাদেশ জাতীয় দল খেলবে না—আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে পেশাদার লীগ কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আগামী ১২ সেপ্টেম্বর মোহামেডান ও বসুন্ধরা কিংসের মধ্যে চ্যালেঞ্জ কাপের মাধ্যমে ২০২৫-২৬ ফুটবল মৌসুম মাঠে গড়াবে।
কিন্তু দেখা গেল, মত পরিবর্তন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোচ এবং দু-একজনের উৎসাহ বড় বেশি। যা হোক ৯ তারিখে খেলা শেষ করে ১০ তারিখে ঢাকায় ফিরে এসে বসুন্ধরা কিংস ও মোহামেডানের খেলোয়াড়রা খেলতে নামবেন—এটি তো অমানবিক বিষয়। তাই চ্যালেঞ্জ কাপের খেলা পিছিয়ে নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে।
আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর। বাফুফের মধ্যে স্ববিরোধিতা এবং সমন্বয়হীনতার এটি একটি উদাহরণ। অতীতেও খারাপ ছিল, কিন্তু সেই খারাপ থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়নি। ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে জাতীয় দল অংশ নেবে আর তাই ক্লাবগুলোকে তাদের খেলোয়াড় ছেড়ে দিতে বলা হয় দু-তিন সপ্তাহ আগে—বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও কি এ ধরনের উদাহরণ আছে! হেড কোচ কেন এই বিষয়টিকে ‘জিদ’ হিসেবে নিচ্ছেন। এতে ক্যাবেরা ও তাঁর ব্যাকরুম স্টাফদের কর্মদক্ষতা এবং সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
খেলোয়াড়দের নিয়ে পুরো মৌসুম কাজ করে ক্লাবগুলো। জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব তো অন্য রকম। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক হৈচৈ বসুন্ধরা কিংস জাতীয় স্বার্থে খেলোয়াড় ছাড়তে চাইছে না। ‘চিলে কান নিয়ে গেছে’—না জেনে, না দেখে মাঠ গরমের চেষ্টা। বলা হয়েছে, বাফুফে থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে, টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা হয়েছে, কোনো সাড়া নেই। বসুন্ধরা কিংস এএফসি চ্যালেঞ্জ লীগের প্লে অফের খেলা খেলতে দেশ ছেড়ে যায়। ১২ আগস্ট রাতে দোহায় শক্তিশালী সিরিয়ার ক্লাবকে পরাজিত (১-০) করে গ্রুপ পর্বে স্থান করে নিয়েছে। সেদিন বিকেলে ঢাকায় আবাহনী লিমিটেড মধ্য এশিয়ার কিরগিজস্তানের একটি ক্লাবের বিপক্ষে ২-০ গোলে পরাজিত হয়ে এএফসি চ্যালেঞ্জ লীগ থেকে বিদায় নিয়েছে। ১৫ আগস্ট থেকে ক্যাবেরার ক্যাম্প শুরু। স্কোয়াডে বসুন্ধরা কিংসের ১০ জন খেলোয়াড়। তাঁরা ১৩ তারিখ রাতে ফিরে ১৫ তারিখে ক্যাম্পে উপস্থিত হবেন, কী অদ্ভুত চিন্তা! আবাহনী থেকে ডাক পাওয়া খেলোয়াড়রা দেশে থাকলেও তো ক্লান্ত।
সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় হলো, বসুন্ধরা কিংস থেকে কখনো বলা হয়নি ন্যাশনাল ডিউটিতে খেলোয়াড় দেওয়া হবে না। এর পরও একটি গোষ্ঠী প্রচারণা কিন্তু বন্ধ করেনি। এ ক্ষেত্রে শুধু ক্লাব নয়, ব্যক্তিগতভাবে ক্লাবসংশ্লিষ্ট কাউকে কাউকে জনসমক্ষে হেয় করার জন্য প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেটি নিন্দনীয়। বাফুফের সঙ্গে জড়িত তাদের এবং বাইরের সর্বদা ‘ভোকাল’দের তো সচেতন মহলের চিনতে বাকি নেই। ফিফার আইন অনুযায়ী খেলোয়াড় ছাড়তে হবে ৭২ ঘণ্টা আগে। এই সবকিছু কিন্তু সবার জানা আছে। ফুটবল ফেডারেশনে যাঁরা পেশাদারি হিসেবে কাজ করছেন, তাঁদের উচিত আগপাছ ভেবে কাজ করা। বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেওয়া। তাল মিলিয়ে দুই নৌকায় পা না দেওয়া। এটি ঝুঁকিপূর্ণ।
বসুন্ধরা কিংস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফুটবল ফেডারেশনে চিঠি দিয়ে পুরো বিষয়টিকে অবগত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন তাঁদের বিভিন্ন ধরনের উদ্বেগ এবং আশঙ্কার বিষয়গুলো। ক্লাব তো লক্ষ্য নির্ধারণ করেই নতুন মৌসুমে মাঠে দল নামাবে। খেলোয়াড়দের প্রতি প্রত্যেক ক্লাবেরই দায়দায়িত্ব আছে। বসুন্ধরা কিংস এসব দায়দায়িত্ব শতভাগ পালন করে থাকে।
যা হোক, ৭২ ঘণ্টা আগে ছাড়ার কথা থাকলেও কিংস তাদের খেলোয়াড়দের ‘রিলিজ’ করে দেবে ৩১ আগস্ট। সম্ভবত হামজা চৌধুরীও এই সময় তাঁর ক্লাব থেকে ‘রিলিজ অর্ডার’ নিয়ে দলের সঙ্গে নেপালে যোগ দেবেন। বিষয়টি খুব ছোট, কিন্তু ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বিষয়টি বড় করা হয়েছে বসুন্ধরা কিংসকে জনসমক্ষে খাটো করার জন্য। পুরো বিষয়টি যখন সাধারণ ফুটবল রসিক বুঝতে পারবে—যাঁরা কৌশলের মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালিয়েছেন, তাঁদের অবস্থা কী হবে? দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এই যে বসুন্ধরা কিংস ঘিরে নেতিবাচক প্রচারণা, এটি কিন্তু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অনুকূলে গেছে। মৌসুম শুরু হওয়ার আগে তারা বারবার আলোচিত হতে পারল। দেশের ডিউটিতে ক্লাব খেলোয়াড় দেয়। আর এই খেলোয়াড় যখন ইনজুরিতে পড়ে মাঠে নামতে পারেন না, তখন ক্লাব ছাড়া ফুটবল ফেডারেশন আর পাশে দাঁড়ায় না। কোচ থেকে শুরু করে কেউ খোঁজও নেয় না। বসুন্ধরা কিংসের বিশ্বনাথ ইনজুরিতে পড়ে গত মৌসুমে মাঠে নামতে পারেননি—তাঁর রিকভারির কাজ এখনো শেষ হয়নি। ক্লাব তাঁর পাশে আছে। এটি ক্লাবের দায়বদ্ধতা।
বসুন্ধরা গ্রুপের এই ক্লাবটির কার্যক্রম কিছু মানুষের কাছে মনঃপূত নয়, এটি বাস্তবতা। কারণ হলো, ক্লাব ফুটবলে এই প্রতিষ্ঠানটি নতুন একটি সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। ক্লাবের পরিবেশ ফুটবল উপযোগী করেছে। খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিককে গুরুত্ব দিচ্ছে। ভালো ফুটবল উপহার দেওয়ার জন্য বারবার দেশি ও বিদেশি খেলোয়াড় নিয়ে দল গঠন করছে। ক্লাবের নিজস্ব আধুনিক অ্যারেনা আছে, যেটি ফিফা এবং এএফসি কর্তৃক স্বীকৃত। এই সবকিছু কেউ কেউ মেনে নিতে পারছেন না। তাই তাঁরা হিংসা ও পরশ্রীকাতরতা থেকে সব সময় অহেতুক পিছে লাগেন এবং বিরুদ্ধাচরণ করেন। এদিকে কিংস ম্যানেজমেন্ট বলছে, আমাদের লক্ষ্য হলো দেশের ফুটবল উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন আর তা সব অংশীদারকে নিয়ে। সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে দেশের ফুটবলের রং পাল্টাতে সময় লাগবে না।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।
বিডি প্রতিদিন/নাজিম