ভুয়া তথ্য ও গুজবের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, যার সিংহভাগই প্রচার পাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে। যে কোনো সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক মন্দার সময় গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক এবং উদ্বেগকে বাড়িয়ে জনসাধারণের মাঝে অস্থিরতা সৃষ্টিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। গুজব প্রতিরোধসহ নানামুখী সংকট ও চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে সময়।
প্রধান উপদেষ্টা গুজব নিয়ে সবাইকে সতর্কতার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, সব সময় মনে রাখতে হবে, আমরা কিন্তু যুদ্ধাবস্থায় আছি। ‘গুজব’ হলো এ জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পরাজিত শক্তির মস্ত বড় হাতিয়ার। গুজব দেখলেই গুজবের সূত্রের সন্ধান করতে থাকবেন। গুজবকে অবহেলা করবেন না। বহু অভিজ্ঞ সমরবিশারদ এ গুজবের পেছনে দিনরাত কাজ করছেন। সীমাহীন অর্থ এর পেছনে নিয়োজিত আছে। এর মূল লক্ষ্য জুলাই অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করা। আমরা তাকে ব্যর্থ হতে দেব না। সামগ্রিক ঐক্য পলাতক শক্তির গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, তারা এ ঐক্য ভাঙতে চায়। তাদের অভিনব কৌশল আপনি টেরই পাবেন না। আপনি বুঝতেই পারছেন না কখন তাদের খেলায় আপনি পুতুল হয়ে গেছেন। আমাদের সচেতনতা এবং সামগ্রিক ঐক্য দিয়েই এ গুজবকে রুখতে হবে। পলাতক অপশক্তির ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিতে হবে।
জুলাই অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে দেশের শিক্ষার্থীরা। কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, হাসিনার পুরো শাসনামলে দেশের মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তাতে যুক্ত হয়ে গণ অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। প্রযুক্তি ও টেকনোলজির সঙ্গে বেড়ে ওঠা এ প্রজন্ম প্রাণপণ লড়াই করে হাসিনার পতন ঘটিয়ে দেশ থেকে খেদিয়ে দিয়েছে। বিশ্বে বাংলাদেশের এ জেন-জির আন্দোলন ব্যাপক নাড়া দেয় এবং তা দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
প্রযুক্তির সঙ্গে বেড়ে ওঠা এ প্রজন্মের প্রায় সার্বক্ষণিক বিচরণ ভার্চুয়াল জগতে। তাদের ভার্চুয়াল সিটিজেনও বলা যায়। তাদের মনমানসিকতা বোঝার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পরিচালকরা ব্যর্থ হলে, তার বিস্ফোরণ ঘটা স্বাভাবিক। চব্বিশের গণ আন্দোলন দমাতে হাসিনা সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দিলেও প্রযুক্তিতে দক্ষ জেন-জির যোগাযোগ বন্ধ করতে পারেনি। তারা বিকল্প মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিকনির্দেশনার মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে হাসিনার পতন ঘটিয়েছে।
গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশে গত এক বছরে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে তার পেছনে এ মাধ্যমের অপব্যবহার রয়েছে। গুজব রটিয়ে সরকারকেও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছে।
জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে বদনাম ও কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে। যত দিন যাচ্ছে তা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে গুজব ও অপতথ্য সাময়িক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলেও পরবর্তীতে তা স্থায়ী হয় না। মানুষ বুঝতে পারে। তবে কিছু মানুষের মধ্যে তাদের এ অপকর্মে সৃষ্ট সন্দেহ ও শঙ্কা থেকেই যায়। কিছু মানুষের এখন মূল টার্গেট নানা গুজব ছড়িয়ে আগামী নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া বা বানচাল করা। যেভাবেই হোক গুজব বন্ধ করতে হবে। এটা চলতে থাকলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। এখন মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুহূর্তের খবর মুহূর্তে পেয়ে যায়। হোক সেটা ভিত্তিসম্পন্ন কিংবা ভিত্তিহীন। কেউ তা বিশ্বাস করে, কেউ করে না। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন সাংবাদিকতারও পরিবর্তন এসেছে।
মোজো বা মোবাইল জার্নালিজমের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। একজন সাধারণ মানুষও কোনো ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে মোবাইলে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ কোনো একটা ইস্যু নিয়ে অসদুদ্দেশ্যে ভুয়া তথ্যের মাধ্যমে মানুষকে উসকে দিয়ে ভায়োলেন্সের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে মব ভায়োলেন্স, গণপিটুনি, সাম্প্রদায়িক হামলা ইত্যাদির মতো যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য দিয়ে উসকানি দেওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। জাতীয় ইস্যুতেও গুজব ছড়িয়ে সরকারকে বিব্রত করার সাম্প্রতিক নজির রয়েছে। কয়েকদিন আগে দেশে জরুরি অবস্থা জারির যে শঙ্কার কথা শোনা গেছে, তার পেছনেও প্রকৃত ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে গুজব রটানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সরকারকে বিবৃতি দিয়ে গুজবের অবসান ঘটাতে হয়েছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য