সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে গ্রামের দরিদ্রদের চেয়ে নগর দরিদ্ররা পিছিয়ে আছে। গ্রামীণ দারিদ্র্য কিছুটা কমলেও শহুরে দারিদ্র্য দ্রুত বাড়ছে। উন্নত জীবনের খোঁজে গ্রামে আসা এই মানুষগুলো শহরের প্রান্তে ঠাঁই পেলেও মৌলিক সেবার নাগালে পৌঁছাতে পারছে না তারা।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) সম্প্রতি এক গবেষণায় বলছে, শহরের দরিদ্ররা সরকারি সুরক্ষা কর্মসূচির মাত্র ৫ ভাগের ১ ভাগ উপকারভোগী। অতিদরিদ্রদের মধ্যে এই বঞ্চনা আরও ভয়াবহ। দেশের প্রায় অর্ধেক অতিদরিদ্র পরিবার কোনো ভাতা বা সুবিধা পায় না, আর শহরে এই হার ৬৪ শতাংশ। র্যাপিডের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা শুরু থেকেই গ্রামীণ ক্ষুধা, দুর্বলতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় তৈরি হয়েছিল। বিধবা, প্রবীণ বা প্রতিবন্ধীদের ভাতা, এমনকি শিক্ষা বৃত্তিও গ্রামীণ পরিবারেই বেশি পায়। শহরের দরিদ্রদের জন্য আলাদা ২৩টি প্রকল্প মিলিয়ে বাজেটের মাত্র ৪ শতাংশ ব্যয় হয়। অথচ গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য থাকা ৫০টি প্রকল্প পায় ২৭ শতাংশ। অধিকাংশ ভাতা ও বৃত্তির ৮০ শতাংশেরও বেশি উপকারভোগী গ্রামে। শহুরে বাস্তবতায় এই বৈষম্য ভয়াবহ। নগর বস্তিগুলোয় মানুষ গাদাগাদি করে থাকে; বিদ্যুৎ, বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। অতি দরিদ্ররা ফুটপাতেই দিন কাটায়। ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার খরচ, বেকারত্ব ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তাদের দুর্ভোগকে গভীর করছে। বিশেষত শিশুদের ভবিষ্যৎ সবচেয়ে অনিশ্চিত, অনেকে স্কুলে যেতে পারে না, অল্প বয়সেই কাজ শুরু করে, ফলে দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরোনোর সুযোগ হারায়। গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে টেকসই দারিদ্র্য হ্রাসে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সামাজিক সুরক্ষা বরাদ্দ অনেক সময় দুর্নীতি ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে নষ্ট হয়। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনি বিতর্কে ব্যস্ত। কিন্তু নগর দরিদ্রদের দৈনন্দিন কষ্ট নিয়ে স্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করেনি।
র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সামাজিক সুরক্ষা খাতের ব্যয় গ্রামাঞ্চলের চেয়ে নগরের মানুষরা কম পায়। গ্রামাঞ্চলের মানুষদের অবশ্যই সুযোগসুবিধা পাওয়া উচিত। তবে নগরেও সেসব সুযোগসুবিধা থাকা উচিত। কারণ মানুষ এখন নগরমুখী। দিনদিন শহরে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তবুও সরকার থেকে এ ব্যাপারে কোনো নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে না। সামাজিক সুরক্ষা খাতে নগরে থাকা মানুষদের প্রতিও সরকারের নজরে আসা উচিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিস্থিতি বদলাতে বাজেটের অগ্রাধিকার পুনর্বিন্যাস ও কর্মসূচির পুনর্গঠন জরুরি। বিদ্যমান ভাতাগুলো শহরের দরিদ্রদের জন্য উন্মুক্ত করা, বস্তিবাসীদের চাহিদা অনুযায়ী নতুন প্রকল্প নেওয়া এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন তারা। পাশাপাশি সঠিক তথ্যভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তুলে দুর্নীতি ও অযোগ্য উপকারভোগীদের সরিয়ে সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে প্রকৃত প্রাপকের কাছে। যথাযথ নীতি ও কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া শহরের দরিদ্ররা যে কষ্টের বৃত্তেই আটকে থাকবে, এমন সতর্কবার্তাই দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নগর দরিদ্রদের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। দৈনিক মজুরির শ্রমিকদের কাজ পাওয়াও এখন দুরূহ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় নগর দরিদ্রদের ঋণের বোঝা বাড়ছে। তাই সময় এসেছে সরকারের এখনই নগর দরিদ্রদের নিয়ে নতুন করে নীতি গ্রহণ করা।