তিন উপায়ে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারকে দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গণভোট, নির্বাহী আদেশ ও অধ্যাদেশ বা বিধি জারি। এর মধ্যে ৪৮টি বিষয়ের ওপর গণভোটের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আর নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ৯টি ও অধ্যাদেশ বা বিধি জারির মাধ্যমে ২৮টি সুপারিশ বাস্তবায়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে কমিশনের এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের পথ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো। তারা বলছে, কমিশন দায়সারা টাইপের কাজ করেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে-এসব সুপারিশ, অনৈক্যের সুপারিশ। জামায়াত জানিয়েছে কিছু উপদেষ্টা একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট দিতে চেয়ে একটি দলকে খুশি করার চক্রান্ত করছে। অন্যদিকে, জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। গতকাল দুপুরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। উপদেষ্টা পরিষদের অন্য সদস্যদের পাশাপাশি এ সময় উপস্থিত ছিলেন- ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, মো. আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। এর মধ্য দিয়ে শেষ হলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের টানা আট মাসের জার্নি।
গতকাল দুপুর ১২টার দিকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এর একটি খসড়াও যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য ‘সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী’ জনগণের অনুমোদন প্রয়োজন এবং সেজন্য গণভোট অনুষ্ঠান, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন ও ওই পরিষদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার ‘অপরিহার্য’। গণভোটে জানতে চাওয়া হবে ভোটাররা জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশে সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবগুলোতে সম্মতি দিচ্ছেন কি না। গণভোটে জনগণের সায় পেলে আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে। তারা একই সঙ্গে জাতীয় সংসদের সদস্য এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে যে সুপারিশমালা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সরকারকে দিয়েছে, সেখানে সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। নির্বাচনের দিন পর্যন্ত গণভোট করতে পারে। তবে এ নিয়ে দিনক্ষণ বেঁধে দেওয়ার পক্ষে নয় কমিশন। এ বিষয়ে তফসিল ঘোষণা করতে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করবে সরকার। কিছু বিষয় অফিস আদেশের মাধ্যমেও বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো গণভোটে উল্লেখ থাকবে না।
এই কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুটি বিকল্পের সুপারিশ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রথম বিকল্পে বলা হয়েছে, গণভোটের আগে জনগণের জ্ঞাতার্থে এবং সাংবিধানিক পরিষদের দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবগুলোর ভিত্তিতে সরকার প্রণীত একটি খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। এই খসড়া বিলের বিষয়টি দ্বিতীয় বিকল্পে রাখা হয়নি। প্রথম বিকল্পে বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ নির্ধারিত ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হলে সংবিধান সংস্কার বিল ‘গৃহীত হয়েছে’ বলে গণ্য হবে এবং তা সংবিধান সংস্কার আইন হিসেবে কার্যকর হবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কমিশন দুটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, দুটি প্রস্তাবের অধিকাংশ বিষয় একই। উভয় সুপারিশেই জুলাই জাতীয় সনদে সংবিধান-সংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে প্রথমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ নামে একটি আদেশ জারির কথা বলা হয়েছে। এরপর সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে জনগণের সম্মতি নেওয়ার জন্য গণভোট আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রথম ২৭০ দিন (৯ মাস) সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। গণভোটে অনুমোদিত প্রস্তাবগুলো এই সময়ের মধ্যে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। দুটি প্রস্তাবের পার্থক্য নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, সরকার চাইলে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বিল আকারে গণভোটে দিতে পারে অথবা জুলাই সনদ আকারেও দিতে পারে। যে সময় হাতে আছে, তাতে বিল আকারে দেওয়া সম্ভব।
সুপারিশে প্রধানত তিনটি ভাগ আছে জানিয়ে কমিশনের সহসভাপতি বলেন, ‘প্রথমটি হচ্ছে যে সকল বিষয়ে সাংবিধানিক বিষয় সংশ্লিষ্ট নয়, সে সমস্ত বিষয়ে সরকার যেগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে সেটা যেন অবিলম্বে সরকারের পক্ষ থেকে বাস্তবায়িত করা হয়। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, এর মধ্যে সুপারিশের অনেক কিছুই আছে যেগুলো সরকারি নির্দেশ এমনকি অফিস অর্ডার দিয়েও বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেগুলো যেন সরকার দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করে। এ দুটো বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত নেই এবং এটা আলোচনার মধ্য দিয়েই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা সেটা সরকারকে অবহিত করেছি। এই সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে বাস্তবায়নের একটি আইনি ভিত্তি প্রদান এবং বাস্তবায়নের পথ নির্দেশ করার জন্য আমরা আমাদের তৃতীয় সুপারিশে কীভাবে এগুলোকে বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হওয়া যায় তার সুপারিশ করেছি।’
উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট সুপারিশ ছিল ভোটের সংখ্যানুপাতে ১০০ সদস্যের একটি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা। কমিশন বলছে, জনগণের সম্মতি পাওয়া গেলে জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠার ৪৫ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হবে।’
আলী রীয়াজ বলেন, ‘সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান, বাস্তবায়নের উপরেখা নির্দেশ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধের প্রেক্ষাপটে আমরা একটি বিশেষজ্ঞ দলের সহযোগিতা নিয়েছি। যাতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন সাবেক বিচারপতি, তিনজন আইনজীবী এবং একজন আইনের শিক্ষক। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত, বিশেষজ্ঞদের মতামত, কমিশনের সদস্যদের অভিজ্ঞতা এবং আন্তরিকতার প্রেক্ষাপটে সুপারিশগুলো তৈরি করেছি। এর লক্ষ্য হচ্ছে, জুলাই জাতীয় সনদ যেন একটি আইনি ভিত্তি পায়। ভবিষ্যতের পথরেখা হিসেবে যে সমস্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত এবং ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো যেন বাস্তবায়িত হয়।’
গণভোটে সংস্কারের প্রস্তাবগুলো পাস না হলে কী হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, ‘গণভোটে যদি পাস না হয়, তার মানে হলো জনগণ সেটা প্রত্যাখ্যান করেছে।’
ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় থাকলেও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ কয়েকটি দল এখনো জুলাই সনদে সই করেনি। তবে কমিশন আশা করছে, শেষ পর্যন্ত সব দলই সনদে সই করবে। চূড়ান্ত দিন পর্যন্ত এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করলে কী হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, ‘কমিশনের সংলাপের শুরু থেকে এনসিপি অংশ নিয়েছে, মতামত দিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা জুলাই সনদের বড় স্টেকহোল্ডার বলে আমি মনে করি।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নতুন বাংলাদেশের পথ দেখাবে : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদের সঠিকভাবে বাস্তবায়ন জাতিকে অতীতের বোঝা থেকে মুক্ত করবে এবং নতুন বাংলাদেশের পথ দেখাবে। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে করা সুপারিশমালা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর আলী রিয়াজের নেতৃত্বে কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার হাতে এ সুপারিশমালা তুলে দেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কমিশন আজ আমাদের হাতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে কাঠামো তুলে দিচ্ছে, সেটি যদি আমরা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি এবং কাজ এগিয়ে নিতে পারি, তাহলে বাংলাদেশ অতীতের বোঝা থেকে মুক্তি পাবে। আমরা চাই নতুনভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে এই সনদ সেই পথ দেখাবে। তিনি বলেন, জাতির ইতিহাসে আজকের দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা যে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম, তার পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল জুলাই ঘোষণা। এরপর এসেছিল জুলাই সনদ। আজ তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সূচনা এটাই আমাদের নতুন অধ্যায়ের শুরু। তিনি আরও বলেন, কমিশনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে যে প্রস্তাব পেশ করা হচ্ছে, তা দেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর আলী রিয়াজসহ সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তাদের দীর্ঘ ও নিরলস পরিশ্রমের ফলেই আজ আমরা এই ঐতিহাসিক দিনটির সাক্ষী হতে পেরেছি। আজ আমরা তাদের প্রস্তুত করা সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানব এবং তা নিয়ে আলোচনা করব। অনুষ্ঠানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন।