জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নতুন ধারার প্রস্তাবনা হচ্ছে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি। এটাকে তারা ইউনিক মডেল হিসেবে মনে করে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো সুপারিশমালায় বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এনসিসিকে নিয়ে। দলগুলোও বিষয়টি নিয়ে তাদের যুক্তি তুলে ধরেছে। পক্ষে-বিপক্ষের মতামতসহ নানা ধরনের বিধান যোগ করার সুপারিশ করেছে। প্রথম ধাপের আলোচনা শেষে এনসিসি নিয়ে দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। বরং এ নিয়ে ব্যাপক মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চায়, সংশোধিত আকারে হলেও যেন এনসিসি আলোর মুখ দেখে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে দলগুলো যে অবস্থান নিয়েছে, তাতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোটা চ্যালেঞ্জে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাষ্ট্রীয় কার্যাবলিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে এনসিসি গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন। এতে বলা হয়েছে, এনসিসি সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত সুনির্দিষ্ট কার্যাবলি, বিশেষ করে বিভিন্ন সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ সংস্থার প্রধানদের নিয়োগ সম্পাদন করবে। বিএনপি সরাসরি সংবিধানে এনসিসি যুক্ত করার বিপক্ষে মত দিয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এর পক্ষে মত দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী সংশোধন সাপেক্ষে এনসিসি সংবিধানে যুক্ত করার পক্ষে। এ ছাড়া মতামত দেওয়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এনসিসি যুক্ত করা নিয়ে রয়েছে নানা মত, নানা পথ। কোনো দল এটা একেবারেই চায় না। আবার কোনো দল সংশোধন সাপেক্ষে যুক্ত করার পক্ষে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রথম ধাপের আলোচনায় এনসিসি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নানা মত দিয়েছে। ১৭ জুন থেকে শুরু হতে যাওয়া দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় যে ১২ বা ১৪টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে এনসিসিও রয়েছে। সাধারণ মানুষ এটাকে খুবই ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। তাই এরকম একটা কাঠামোতে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আশা করি, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সংশোধনী আকারে হলেও এ ধরনের কাঠামো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে।’
বিএনপি তাদের লিখিত মতামতে প্রস্তাবিত সুপারিশগুলো ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে কমিশনকে জানিয়েছে। দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এরূপ কাউন্সিলের কার্যকারিতা যথেষ্ট প্রমাণিত নয়। বিদ্যমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায় যে কোনো অপ্রমাণিত পদ্ধতির এক্সপেরিমেন্ট হিতে বিপরীত হতে পারে। এর মাধ্যমে সাংবিধানিক পদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অচলাবস্থা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে যখন নির্বাচনের সময় আসে তখন শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে মতপার্থক্য তৈরি হয়। যারা ক্ষমতাসীন দলে থাকেন তারা কীভাবে আবার ক্ষমতায় আসতে পারেন, সে ধরনের মেকানিজমের মধ্যে ঢুকতে চান। প্রধান উপদেষ্টা কীভাবে হবেন, অন্য উপদেষ্টা কীভাবে হবেন, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। আমরাও কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছি, যারা এনসিসির মেম্বার আছেন তাঁদের মধ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেতা এবং রাষ্ট্রপতি ছাড়া অন্যরা যাঁরা আছেন, তাঁদের কীভাবে নিয়ে আসা যায় বা অন্য ব্যক্তিদের কীভাবে এখানে ইনক্লুড করা যায়।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এনসিসির মতো বিষয় এই সময়ে অপ্রয়োজনীয়। এসব আনা মানে জাতীয় নির্বাচন বিলম্ব করা। যেসব রাজনৈতিক দল এটা করতে চায় তাদের বলব আগে নির্বাচন করে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আসেন। তারপর এটা করেন।’ প্রায় একই সুরে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘সংস্কারে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল রাখাকে একেবারে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করি। আমরা কমিশনের ওই সুপারিশের সঙ্গে একেবারে দ্বিমত পোষণ করেছি। দ্বিতীয় দফার আলোচনায় যদি এনসিসিকে রাখা হয় তাহলেও একই মত দেওয়া হবে।’ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এনসিসির আইডিয়াটা আমরা গ্রহণ করেছি। তবে কমিশন যেভাবে চেয়েছে আমরা তার সংশোধনী দিয়েছি। বলেছি কিছু ক্ষেত্রে সংশোধনী করে এটাকে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।’