গ্যাসের তীব্র সংকটে ধুঁকছে দেশের শিল্প খাত। বাসাবাড়ি ও যানবাহন খাতেও গ্রাহকদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। শিল্পোদ্যোক্তারা জানান, এক-তৃতীয়াংশ কারখানায় দিনে গ্যাসের চাপ থাকে না। এতে উৎপাদন আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে। বিকল্প ব্যবস্থায় কারখানা সচল এবং রাতে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানোয় উৎপাদন খরচও বেড়েছে ৩০ শতাংশ। শিল্পে নতুন সংযোগও প্রায় বন্ধ আছে। এতে বিনিয়োগও থমকে আছে। বাড়ছে না নতুন কর্মসংস্থান। বাসাবাড়িতে দিনের রান্না করতে হচ্ছে গভীর রাতে। এলপিজি সিলিন্ডারসহ বিকল্প ব্যবস্থায় যাচ্ছেন আবাসিকের গ্রাহকরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিএনজি স্টেশনের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও পর্যাপ্ত গ্যাস পাচ্ছেন না গাড়িচালকরা।
শিল্পমালিকরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, কারখানায় গ্যাসের চাপ যেখানে ১৫ পিএসআই থাকার কথা, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে এক পিএসআই বা তার চেয়েও কম। রাতে কিছুটা পাওয়া গেলেও দিনে মিলছে না। শ্রমিকরা দিনে অলস সময় পার করছেন। রাতে কাজ করাতে হচ্ছে। এতে নারী শ্রমিকদের যাতায়াতে নিরাপত্তা শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া নাইট অ্যালাউন্স দিতে হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ। উৎপাদন খরচ বাড়ছে ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ। দিনে-রাতে শ্রমিকদের কাজ করানোর জন্য সমন্বয়হীনতার কারণে উৎপাদনও কমছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সিএনজি, এলপিজি ও ডিজেল দিয়ে উৎপাদন ধরে রাখতে গিয়ে মালিকরা হিমশিম খাচ্ছেন। খরচ জোগাতে না পেরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেক মালিক সময়মতো ক্রেতার অর্ডার পাঠাতে পারছেন না। বাতিল হয়ে যাচ্ছে রপ্তানি আদেশ। অনেক ক্রেতা এরই মধ্যে অন্য দেশে অর্ডার নিয়ে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কারখানায় দিনে গ্যাস থাকে না। রাত ১২টা পর বাসাবাড়িতে গ্যাস ব্যবহার বন্ধ হলে কিছুটা গ্যাস আসা শুরু হয়। যা সকাল ৫টা পর্যন্ত থাকে। এটি সর্বোচ্চ তিন থেকে চার পিএসআই। বর্তমানে মালিকরা চাহিদার ২০ শতাংশ গ্যাস পাচ্ছেন।
জানা যায়, মানিকগঞ্জ, ধামরাইয়ে দিনে গ্যাসের চাপ থাকছে শূন্য পিএসআই। গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়ায় শূন্য দশমিক ৫ থেকে সর্বোচ্চ দুই পিএসআই গ্যাস পাওয়া যায়। ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার আশুলিয়া ও ভালুকাসহ দেশের শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন শিল্প খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাত। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে সিরামিক ও স্টিল খাতসহ অন্যান্য শিল্পেও।
গাজীপুরে শিল্পকারখানার বেশির ভাগই তৈরি পোশাকশিল্প। ওষুধ, চামড়া, সিরামিকের কারখানাও রয়েছে। সব মিলিয়ে গাজীপুরে ৫ হাজারের মতো ছোট-বড় কারাখানা আছে। বেশির ভাগই গ্যাসনির্ভর। ডাইং কারখানার বয়লার সচল রাখতে ন্যূনতম তিন পিএসআই গ্যাসের সরবরাহ প্রয়োজন হয়। পাওয়া যাচ্ছে এক পিসিআইয়ের মতো।
স্টিল মিল কারাখানাগুলোরও একই অবস্থা। দিনে গ্যাসের চাপ না থাকায় কারখানা চলছে রাতে। খরচ বেড়েছে দেড় থেকে দুই গুণ। বয়লার দিয়ে উৎপাদনের চেষ্টা চালালেও উৎপাদন কমেছে অর্ধেকেরও বেশি।
আবাসিকে একদিকে সরবরাহ কম। অন্যদিকে একেক দিন একেক এলাকায় বিভিন্ন কাজের জন্য গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন রাজধানীর বাসিন্দারা। বাধ্য হয়ে এখন অনেকেই বিকল্প জ্বালানি হিসেবে এলপিজিসহ অন্য মাধ্যম ব্যবহার শুরু করেছেন।
গ্যাসসংকটের প্রভাব পড়েছে পরিবহন খাতেও। সিএনজি স্টেশনগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ির দীর্ঘ লাইন দেখা যাচ্ছে। কমপ্রেসার চালু করেও চাহিদার অর্ধেক গ্যাসও তারা দিতে পারছেন না। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও প্রাইভেটকারের চালকরা। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে অর্ধেক জ্বালানি নিয়েই তারা স্টেশন ছাড়ছেন।
গত ৭ মে শিল্পপতিদের সঙ্গে এক বৈঠকে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানান, রমজানে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সামলাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হয়েছিল। এখন বিদ্যুৎ থেকে নিয়ে হলেও শিল্পে সরবরাহ বাড়ানো হবে। পাশাপাশি এলএনজি আমদানি প্রবাহ বাড়ানো হয়েছে। এরপরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিস অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারাস অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি মো. শাহরিয়ার বলেন, শিল্পমালিকদের সঙ্গে জ্বালানি উপদেষ্টার চলতি মাসের শুরুতে বৈঠক হয়। সেখানে আশ্বাস দেওয়ার পরও শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়েনি। উল্টো কমেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে গ্যাসনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠান যেগুলো আছে সেগুলো বন্ধ হবে। সামনে ঈদ। আমরা বেতন-বোনাস দিতে পারব না। এতে শ্রমিক আন্দোলন বেড়ে যাবে।
দেশে বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি ১ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, সরবরাহ করা মোট গ্যাসের মধ্যে ৪৩ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে, ১৮ শতাংশ শিল্পকারখানায় এবং অন্যান্য খাতে ২৮ শতাংশ। আবাসিক খাত পাচ্ছে মাত্র ১১ শতাংশ গ্যাস।