জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম দ্রোহ, প্রেম, চেতনা, মানবতা ও সাম্যের অনন্য দৃষ্টান্ত। লেখনীর মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্যহীন সমাজের জয়গান গেয়েছেন তিনি। গতকাল ছিল কবির ১২৬তম জন্মবার্ষিকী। কবির সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা, জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা, নাচ, গান, নাটক, আবৃত্তিসহ নানান বর্ণাঢ্য আয়োজনে সাজানো ছিল কবির জন্মজয়ন্তীর এই আয়োজন।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় : জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জন্মজয়ন্তী উদ্যাপনের অংশ হিসেবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় কুমিল্লায় শুরু হলো তিন দিনের নজরুল উৎসব। আয়োজনের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে কুমিল্লা জেলা প্রশাসন।
গতকাল বিকালে কুমিল্লা শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হওয়া ‘চব্বিশের গণ অভ্যুত্থান : কাজী নজরুলের উত্তরাধিকার’ শীর্ষক এই উৎসবের উদ্বোধনীতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতিবিষয়ক
মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিদুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মো. লতিফুল ইসলাম শিবলী এবং কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান। এতে স্মারক বক্তৃতা করেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান এবং স্বাগত বক্তৃতা করেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার। অনুষ্ঠানে ‘নজরুল পুরস্কার ২০২৩ ও ২০২৪’-এর জন্য মনোনীত গুণীজনদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। আলোচনাপর্ব শেষে শুরু হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির বিশেষ নিবেদন ‘চেতনা ও জাগরণে নজরুল’ শীর্ষক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আগামীকাল শেষ হবে তিন দিনের এই উৎসব।
ফুলে ফুলে ঢাকা কবির সমাধি : ফুলে ফুলে ঢাকা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিসৌধ। জন্মদিনের সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদসংলগ্ন কবির মাজারে ফুলেল শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, ছায়ানটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্বের শুরুতেই এক মিনিট নীরবতা পালন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খানের সভাপতিত্বে নজরুলের জীবনকর্ম ও সাহিত্য নিয়ে বক্তৃতা করেন প্রো ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা এবং কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক এম. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। অনুষ্ঠানে উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভবিষ্যতে যেসব হল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, সেখানে একটি হলের নাম জাতীয় কবির নামে হবে বলে জানিয়েছেন।
এর আগে উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খানের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শোভাযাত্রা নিয়ে কবির সমাধিতে গিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর তাঁরা ফাতেহা পাঠ করেন। অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম ‘চব্বিশের গণ অভ্যুত্থান : কাজী নজরুলের উত্তরাধিকার’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা দেন।
বিএনপি : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির পক্ষ থেকে কবির সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির সাংস্কৃতিক সম্পাদক চিত্রনায়ক আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জল।
শিল্পকলা একাডেমি ও সাংস্কৃতিক কর্মী সংঘ: আলোচনা, নাটক, মূকাভিনয়, নাচ, গানসহ নানা আয়োজনে জাতীয় কবির জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন করেছে যৌথভাবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও সাংস্কৃতিক কর্মী সংঘ। আয়োজনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কর্মী সংঘের সাধারণ সম্পাদক নাট্যজন খন্দকার শাহ আলম।
ছায়ানট : জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনে দুই দিনব্যাপী নজরুল উৎসবের আয়োজন করেছে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। গতকাল সন্ধ্যায় উৎসবের প্রথম দিবসের আয়োজনে সম্মেলক নৃত্যগীত, নজরুলজয়ন্তী নিয়ে কথন, ‘দেশ গৌড়-বিজয়ে দেবরাজ’ শীর্ষক সম্মেলক গান, নজরুলের ‘কাবেরী তীরে’ শীর্ষক গীতি আলেখ্য, আবৃত্তি, দলীয় সংগীত, ‘মেঘের হিন্দোলা দেয়’ শীর্ষক গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করা হয়।
বাংলা একাডেমি : সেমিনার, নজরুল পুরস্কার প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নজরুলজয়ন্তী উদ্যাপন করেছে বাংলা একাডেমি। বিকাল ৪টায় একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনের এই আয়োজনে নজরুলবিষয়ক সেমিনারে নন্দনের ‘বাঁশরী ও তূর্য’ অথবা নজরুলের সাহিত্য-চিন্তার কয়েক দিক শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টাঙ্গাইলের করটিয়া সরকারি সা’দত কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জগলুল আসাদ। আলোচক ছিলেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির খণ্ডকালীন শিক্ষক ও ‘বাঙ্গালা গবেষণা’র পরিচালক আফজালুল বাসার। সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। সাংস্কৃতিক পর্বে নূর হোসেন রানার নির্দেশনা ও পরিচালনায় পরিবেশিত হয় গীতিনাট্য ‘দেখব এবার জগৎটাকে’। আবৃত্তি করেন লিজা চৌধুরী ও শামীমা চৌধুরী। নজরুলগীতি পরিবেশন করেন সালাউদ্দিন আহমেদ, সুমন মজুমদার, আজগর আলীম, ফারাহ দিবা খান লাবণ্য। অনুষ্ঠানে নজরুল পুরস্কার ২০২৫ প্রদান করা হয় নজরুল গবেষক অধ্যাপক আনোয়ারুল হক এবং নজরুলসংগীতশিল্পী শবনম মুশতারীকে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ অধ্যাপক আনোয়ারুল হককে ও নজরুলসংগীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শবনম মুশতারীকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। নজরুল পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে তাঁদের প্রত্যেককে ১ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়।
জাসাস : আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন করেছে জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)। বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি কনফারেন্স মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় এই আয়োজন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান। জাসাস আহ্বায়ক চিত্রনায়ক হেলাল খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ কামরুল আহসান, বিএনপির সহসাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক সাইদ সোহরাব, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন প্রমুখ। পরে সংগঠনের শিল্পীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন।
ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানান, ত্রিশাল প্রেস ক্লাবের আয়োজনে বর্ণাঢ্য ‘নজরুল র্যালি’র মধ্যে দিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মজয়ন্তী শুরু হয়েছে ময়মনসিংহের ত্রিশালে। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে বর্ণাঢ্য র্যালি শুরু হয়ে পৌর শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। র্যালিতে প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবদুল্লাহ আল বাকিউল বারী। পৌর শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মীরা র্যালিতে অংশ নেন।