দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের দুর্বল ব্যবসার পরিবেশ চীনা বিনিয়োগের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দেশটির ব্যবসায়ীরা এখানে স্থাপনা গড়ে তোলার জন্য বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নের আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশ-চীন অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের (ডব্লিউজি) বৈঠকে এসব কথা উঠে এসেছে।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ সভায় অনেক চীনা ব্যবসায়ী বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং ব্যবসা পরিবেশ উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছেন। ছয় বছর পর এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকায় চীনা দূতাবাস এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রতিনিধিরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মিরানা মাহরুখের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বেইজিং ও ঢাকার মধ্যে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
আগামী ১ জুন ঢাকায় বাংলাদেশ-চীন যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জেইসি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তার আগে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের (ডব্লিউজি) বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার চীন। গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) চীন থেকে ১৬৬ কোটি ৩৭ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ, যা মোট আমদানির ২৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। এটি বাংলাদেশে চীনা পণ্যের উচ্চ চাহিদার ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, হংকংসহ চীন বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ২৭৮ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। ফলে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী হিসেবে অবস্থান করছে চীন। চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো টেক্সটাইল, জ্বালানি, উৎপাদন এবং অবকাঠামো খাত যেমন পদ্মা সেতু ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন খাতে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছে। অনেক চীনা কোম্পানি উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং ভূরাজনৈতিক টানাপড়েনের কারণে তাদের উৎপাদন ঘাঁটি বৈচিত্র্যময় করতে চাচ্ছে এবং ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে সম্ভাব্য গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করছে। এবিষয়ে বাংলাদেশ-চীন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) একজন নেতা বলেন, বাংলাদেশ চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্রিয়ভাবে কাজ করলেও ব্যবসা পরিবেশের একাধিক দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার কারণে চীনা কোম্পানিগুলো সম্পূর্ণভাবে বিনিয়োগে অঙ্গীকার করতে দ্বিধান্বিত। বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান, প্রতিযোগিতামূলক শ্রম ব্যয় এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অবকাঠামোগত ঘাটতি, নীতির অসংগতি এবং স্বচ্ছতার অভাব বিদেশি, বিশেষ করে চীনা বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করছে বলেও তিনি জানান। সম্প্রতি ইআরডিতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং গ্রুপ বৈঠকে অংশ নেওয়া এক কর্মকর্তা বলেন, চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হলেও, দেশের দুর্বল ব্যবসা পরিবেশ তাদের নিরুৎসাহিত করছে। চীনা পক্ষ বাংলাদেশকে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে অনুরোধ জানিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে লাইসেন্সিং ব্যবস্থার সহজীকরণ, ভূমি ও জ্বালানির সহজ প্রাপ্যতা, বিনিয়োগ সংক্রান্ত স্থিতিশীল নীতি এবং মুনাফা প্রত্যাবাসনের সুবিধা, বলেন ওই কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চীনা পক্ষকে সরকারের ব্যবসা পরিবেশ উন্নয়নে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করেছি।’ তবে চীনা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ প্রায়ই মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে নানা ধরনের জটিলতার মুখে পড়ে। বিশ্লেষক ও চীনা ব্যবসায়ীরা বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রশাসনিক অদক্ষতা, অনুমোদন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, শুল্ক প্রক্রিয়ার জটিলতা এবং সরকারি সংস্থাগুলোর অকার্যকারিতার কারণে বিনিয়োগে দেরি ও খরচ বেড়ে যায়। প্রয়োজনীয় অনুমোদন ও লাইসেন্স পেতে দীর্ঘ সময় লাগে ও প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল। কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও বাংলাদেশ এখনো অবকাঠামোগত ঘাটতির মুখোমুখি। অস্থির বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ, বন্দরে জট এবং অপর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা জানান। চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য আনোয়ারায় প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নের ধীরগতি এই চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। যদিও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এই অবস্থার উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বৃহৎ আকারের অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে এবং আঞ্চলিক বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর একীভূতকরণের মাধ্যমে এফডিআই প্রক্রিয়া সহজীকরণে কাজ করছে। অন্তর্বর্তী সরকার চীনা বিনিয়োগ বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা, সৌর প্যানেল উৎপাদন এবং উচ্চ মূল্যের টেক্সটাইল খাতে আকৃষ্ট করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে চীনের শিল্প স্থানান্তরের সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে অধিক পরিমাণে বিনিয়োগ আনতে হলে বাংলাদেশকে মৌলিক সংস্কার আনতেই হবে। প্রশাসনিক অদক্ষতা, দুর্নীতি, অবকাঠামোগত ঘাটতি এবং নীতি অস্থিরতার মতো মূল সমস্যা সমাধান করাই বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির চাবিকাঠি এবং চীনা ও অন্যান্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের পূর্বশর্ত। এই ব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া, বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ এফডিআই পাওয়ার দৌড়ে আঞ্চলিক প্রতিযোগীদের থেকে পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন।