গুম ও আয়নাঘরে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনায় শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, জড়িয়ে পড়েছিল বিচার বিভাগও। গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হলে জোরপূর্বক ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ে ভূমিকা রাখেন অনেক ম্যাজিস্ট্রেট। আবার অনেক বিচারক গুমের ঘটনা শোনার পর আইনের দোহাই দিয়ে ভিকটিমকে ফের রিমান্ডে পাঠান। গত ১৫ বছরে গুমের ঘটনাগুলো তদন্তে গঠিত গুম কমিশনকে এমন তথ্য জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। কমিশন প্রতিবেদনে জানা গেছে, দীর্ঘদিন আটকে রেখে নির্যাতনের পর ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হতো। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে আগে থেকে লিখে রাখা বক্তব্য মুখস্থ করানো হতো। অনেক ম্যাজিস্ট্রেট জোরপূর্বক জবানবন্দি আদায়ে ভূমিকা রাখতেন। এ সময় ভুক্তভোগীকে দেওয়া হতো না কোনো আইনি সহয়তা বা আইনজীবী।
২০২০ সালে গুম হয়ে ৪৪ দিন নিখোঁজ ছিলেন ১৯ বছর বয়সী এক কিশোর। পরে তাকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়। গুম কমিশনে ওই যুবক বলেন, কোর্টে কী কী বলতে হবে তা সারা রাত আমাকে পড়ানো হয়। সকালবেলা আবার বলা হয়, কোর্টে যাই জিজ্ঞাসা করুক, তুমি এটাই বলবা। মাজিস্ট্রেটকে আমি বলেছি, স্যার, আমি একটু আপনার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই...। ম্যাজিস্ট্রেটকে যখন আমি বলছি, স্যার, এগুলো আমি করিনি। আমার মারধর করে, জোর করে এগুলা বলিয়ে নিয়েছে। মাজিস্ট্রেট বলছে, ঠিক আছে, আমি দেখতেছি। কিন্তু তার পরও সে এটা আমার বিপক্ষে লিখেছে। কারণ, এতদিন আমাকে গুম রাখছে, অন্য কোনোদিন কিন্তু তারা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আনতে পারত না। যেদিন তাদের পছন্দের ম্যাজিস্ট্রেট ছিল, সেদিনই তারা আমাকে কোর্টে হাজির করেছে।
২০১৭ সালে গুম হয়ে ২৮ দিন নিখোঁজ ছিলেন ১৯ বছর বয়সি আরেক কিশোর। কোর্টে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে গুম কমিশনে তিনি বলেন, আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে বললাম, স্যার, আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। উনাদেরকে (পুলিশকে) রুম থেকে বের করেন। স্যার বললেন, ‘উনারা বের হবে না, যা বলার এখানে বল’। আমি বলছি, ‘স্যার, আমাকে উনারা গুম রাখছে। আমার বাবা-মা জানে না আজ পর্যন্ত আমি বেঁচে আছি কী মরে গেছি। যা লিখেছে তা আমাকে মুখস্ত করানো হয়েছে। স্যার, আমি এ সম্পর্কে কিছুই জানি না।’ স্যার কম্পিউটারে টাইপ থেকে অনেকগুলো লেখা কেটে দিয়ে বলেন, ‘দেখ, অনেক লেখা কেটে দিয়েছি, আর কাটা যাবে না। যা আছে এখানে সাইন করো।’ আমি বললাম, ‘স্যার, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে। আমার সামনে পরীক্ষা। আপনি উনাদের বের করেন।’ কোনোভাবেই উনাকে আমি ম্যানেজ করতে পারলাম না। পরবর্তীতে যখন আমি ম্যাজিস্ট্রেটের লেখাটা পড়তে গেলাম, তখন উনি আমাকে বলেন, ‘তোমার তো এত জায়গা-জমি নেই যে আমি লিখে নিয়ে যাব। সাইন করতে বলছি, সাইন করো।’ আমাকে উনি কোনো সুযোগ দেননি। কোনো সময় দেননি। ৩৭ বছরের এক যুবক ২০১৭ সালে গুম হয়ে ১১ দিন নিখোঁজ ছিলেন। পরে তাকে জবানবন্দির জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়। তিনি গুম কমিশনে বলেন, ‘আমার দুটা হাত বাঁধা। ম্যাজিস্ট্রেট আমারে জিজ্ঞেস করতেছে আর লিখতেছে। একবার জিজ্ঞেস করেছে, আপনার বাসায় কি লাইব্রেরি আছিল? আমি বলছি, আমার বাসায় বই ছিল, লাইব্রেরি ছিল। তো আপনারা কি ওখানে বসে বন্ধুবান্ধব আড্ডা দিতেন? আমি বলেছি, মাঝে মাঝে আসত, গল্প করতাম, এ কথাটাই আমি বলেছি। কিন্তু তিনি লিখেছেন, আমি জিহাদি কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলাম... আমি তো তাকে এই কথাটা বলিনি কখনো।’
২৫ বছর বয়সী যুবক ২০১৯ সালে গুম হয়ে ১৩ দিন নিখোঁজ ছিলেন। পরে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। তিনি বলেন, জজ সাহেব জানতে চান আমাদের কোনো উকিল আছে কি না। আমাদের গুম অবস্থা থেকে সরাসরি ওখানে নিয়ে গেছে। কীভাবে উকিল ধরব? বললাম, উকিল নেই। জজ সাহেব চার দিনের রিমান্ড দিলেন। ২৭ বছর বয়সি যুবক ২০১৯ সালে গুম হয়ে নিখোঁজ ছিলেন ৪২ দিন। পরে তাকে জবানবন্দির জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়। তিনি গুম কমিশনে বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নিয়ে গেছে... তো আমি উনার কাছে বললাম, এরা আমারে আটকা রাইখা এতদিন মারছে, পিটাইছে। আমি জানি না, আমার বাসার লোকজন কেমন আছে। ওরা জানে না আমি কেমন আছি। উনি বলেন, কী করমু ভাই? আপনার নাম তো এজহারে আছে। যেই মামলা, আপনারে রিমান্ড তো দেওয়াই লাগে। আমি বললাম, আমি এতটা দিন এগো কাছে ছিলাম। উনি জিজ্ঞাসা করেন- কই ছিলেন? আমি বললাম, যে র্যাবরা দিয়া গেছে। র্যাবদের কাছে ছিলাম। উনি বলেন, র্যাব অফিসে ছিলেন? বললাম, জি। উনি বলেন, কী করমু এখন? এটা তো নিয়ম, দেওয়াই লাগে। তো উনি আবার তিন দিনের রিমান্ড দেন।