সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলামের আদি ব্যবসা ছিল চোরাচালান। চোরাচালানের মাধ্যমেই ব্যবসায় হাতেখড়ি হয়েছিল তাজুলের। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কলকাতায় অবস্থান করছেন এই দুর্নীতিবাজ দুর্বৃত্ত। সেখান থেকে তিনি আবার তাঁর পুরোনো ব্যবসা নতুন করে চালু করেছেন। একাধিক অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তাজুল কলকাতায় অবস্থান করে বাংলাদেশ-ভারত চোরাচালান চক্রের নতুন একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কলকাতায় বসেই তিনি কলকাঠি নাড়াচ্ছেন। আনার হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশ-ভারত চোরাচালান রুটে সৃষ্টি হয়েছিল শূন্যতা। সে শূন্যতা পূরণ করেছেন তাজুল। কলকাতায় চোরাচালানের পুরোনো সাথিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নতুন করে শুরু করেছেন তাঁর আদি ব্যবসা। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাঁর বিপুল পরিমাণ সম্পদ আছে। তাঁর ঘনিষ্ঠরা সেসব সম্পদ দেখভাল করছেন। তাজুলের আত্মীয় এবং এপিএস এখন দুবাইতে অবস্থান করছেন। দুবাইয়ে তাজুল ইসলামের রয়েছে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি। দুবাই ছাড়াও তাজুল ইসলামের সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায়। তবে তাজুল কৌশলগত কারণে কলকাতায়ই অবস্থান করছেন। তাঁর ছোট ভাই অবস্থান করছেন দুবাইতে এবং তাঁদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। সবকিছুই পরিচালিত হচ্ছে তাজুলের নির্দেশে।
কলকাতা থেকে তিনি দুবাই যাচ্ছেন না, এ কারণে যে দুবাইয়ে তাঁর যেসব সম্পদ আছে সেগুলো দেখভাল করার জন্য তাঁর বিশ্বস্ত লোক রয়েছেন। কলকাতা থেকে ব্যবসা পরিচালনা তাঁর জন্য সহজ। এখনো বিপুল অবৈধ অর্থের লেনদেনের লোভেই কলকাতায় থিতু হয়েছেন তাজুল ইসলাম। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, তাজুল ইসলাম এবং তাঁর স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলামের দুবাইতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুবাইতে অন্তত চারটি অ্যাপার্টমেন্টের মালিক তাজুল ইসলাম। এসব অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এখন তাঁর ছোট ভাই এবং এপিএস এগুলো দেখাশোনা করেন। এ ছাড়া তাজুল ইসলামের দুবাইতে আরও কিছু বিনিয়োগ রয়েছে। তবে সে সবই বেনামে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে তাজুল ইসলামের একাধিক বাড়ি রয়েছে। সেগুলোও বেনামে। এসব বাড়ি দেখভাল করেন তাজুল ইসলামের ছেলে ও ভাতিজা।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, নিউইয়র্কে এবং ফ্লোরিডায় তাজুল ইসলামের দুটি বাড়ি রয়েছে। যে বাড়িগুলোর প্রাক্কলিত মূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২০ কোটি টাকা। কানাডার টরন্টোতেও তাজুল ইসলামের বাড়ির খবর পাওয়া গেছে। যে বাড়িটি তাঁর বিশ্বস্ত কেয়ারটেকারের মাধ্যমে দেখাশোনা করছেন। দেশে তাঁর যে সম্পদ জব্দ হয়েছে তা তাঁর প্রকৃত সম্পদের তুলনায় সামান্যই। দেশে তাজুলের বেশির ভাগ সম্পদই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে, তেমনি তাঁর বিদেশের অবৈধ সম্পদ সম্পর্কে এখনো কোনো খোঁজখবরও নেয়নি দুদক। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘বেনামি সম্পদগুলোর ব্যাপারে দুদক কিছু করতে পারছে না। দুদক শুধু সেটুকুই জব্দ করেছে যেটুকু তাঁর নিজের বা তাঁর পরিবারের নামে। যেসব সম্পদ বেনামে রয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে কোনো কিছু করার ক্ষেত্রে আইনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলেও দুদকের ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তাজুল ইসলাম এবং তাঁর স্ত্রীর দেশে বিভিন্ন নামে, এমনকি তাজুলের ড্রাইভারের নামেও জমি এবং ফ্ল্যাট রয়েছে। শুধু গুলশান, বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় নয়, ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, খিলগাঁও, মিরপুরের মতো জায়গায় তাজুল ইসলাম প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন। এক সূত্র দাবি করেছেন, সারা ঢাকা শহরে তাজুল ইসলামের অন্তত ৪২টি ছোটবড় ফ্ল্যাট রয়েছে। বিভিন্ন শপিং মলে দোকান রয়েছে অন্তত ৫০টি। এসব ফ্ল্যাট ও দোকান তাঁর সহকারী, গৃহকর্মী এবং ড্রাইভারের নামে কেনা হয়েছে।
তাজুল ইসলামের ব্যক্তিগত ড্রাইভার ছিলেন আজমল। আজমলের নামে মিরপুরে একটি এবং জোয়ারসাহারায় একটি করে অ্যাপার্টমেন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। বর্তমানে আজমল পলাতক অবস্থা রয়েছেন। তবে এ অ্যাপার্টমেন্টগুলো ভাড়া দেওয়া আছে। এ অ্যাপার্টমেন্টগুলোয় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা বাড়িতে ভাড়া থাকেন তাঁরা জানেন এটি মন্ত্রী তাজুল ইসলামের বাড়ি। ধানমন্ডি এবং খিলগাঁওয়ে দুটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে তাজুল ইসলামের বিশেষ সহকারীর নামে। এ ছাড়া তাজুল ইসলাম একটি ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার, সেই ব্যাংকের দুজন কর্মকর্তার নামে বাড়ি আছে। এগুলো আসলে কোনোটাই ওই সব ব্যক্তির নয়। তাজুল ইসলাম তাঁদের দিয়ে রেজিস্ট্রি করেছেন। আবার হেবা দলিলের মাধ্যমে এসব সম্পদের নিজের মালিকানা নিশ্চিত রেখেছেন। এ বাড়িগুলো এখন পর্যন্ত জব্দ করা হয়নি। এসব বাড়ির ভাড়া বাবদ যে বিপুল পরিমাণ অর্থ আসছে, ইে অর্থগুলো হুন্ডির মাধ্যমে কলকাতায় যাচ্ছে তাজুল ইসলামের কাছে। বিভিন্ন সূত্র বলছেন, বাংলাদেশে এখনো তাজুল ইসলামের বিপুল বিনিয়োগ আছে এবং সেখান থেকে টাকা তোলা হচ্ছে। কুমিল্লা শহরে তাজুল ইসলামের বেনামে একটি বহুতল মার্কেট রয়েছে, যেখান থেকে প্রতি মাসে অন্তত ১০ লাখ টাকা ভাড়া ওঠে। এ ভাড়াগুলো সংগ্রহ করে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়। আর এ কারণেই নির্ভাবনায় নিশ্চিন্তে তাজুল ইসলাম এখন কলকাতায় সপরিবার অবস্থান করছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা যায়, কলকাতায় আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতা অভাব-অনটন-দুরবস্থার মধ্যে কাটালেও তাজুল নিউটাউনে সুরম্য একটি ফ্ল্যাটে সপরিবার থাকছেন। এ বিশাল ফ্ল্যাটটিতে ভাড়ায় থাকেন বলা হলেও কেউ কেউ মনে করছেন চোরাচালানের যে সিন্ডিকেট, তাদের পক্ষ থেকে তাঁকে সেখানে রাখা হয়েছে। যেখানে তাঁকে কোনো ভাড়া দিতে হয় না। বাংলাদেশে যেমন রাজকীয়ভাবে তাজুল ইসলাম চলতেন, এখন কলকাতায়ও একই রাজকীয় কায়দায় তিনি চলাফেরা করছেন। বিলাসবহুল গাড়ি এবং দামি বাড়ি ছাড়াও তাজুল ইসলামের রয়েছে ব্যক্তিগত কর্মচারী। সম্প্রতি একটি অফিসও নিয়েছেন বলে এক সূত্র দাবি করেছেন। তবে এর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সূত্র বলছেন, তাজুল ইসলাম খুব শিগগিরই দুবাই যাবেন।
এক সূত্র বলছেন, ৫ আগস্টের পরপরই তাজুল ইসলাম বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠদের বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর এপিএস এবং ছোট ভাই দুজনই ৩ আগস্ট দুবাই চলে যান এবং সেখানেই অবস্থান করছেন।
অন্যদিকে তাজুল ইসলামের স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলাম ৫ আগস্টের পর কিছুদিন কলকাতায় অবস্থান করে দুবাই গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আবার কলকাতায় আসেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছেন, তাজুল ইসলাম তাঁর পুরোনো ব্যবসা ঠিকঠাক করে দুবাইতে পাড়ি দেবেন এবং সেখানেই অবস্থান করবেন। গত ১৫ বছরে রাজনীতি ব্যবসায় পরিণত করা এই দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুণ্ঠন করেছেন, তার খুব সামান্যই এখন পর্যন্ত নজরে এসেছে এবং দুদক সেগুলো জব্দ করেছে। এখনো বিপুল পরিমাণ সম্পদ ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং ৫ আগস্টের পরও তাজুল বহাল তবিয়তে অবস্থান করছেন।