সন্তান মানুষের জীবনের যেমন সর্বোচ্চ আনন্দময় অধ্যায় তেমনি সবচেয়ে কঠিন দায়িত্বও বটে। সন্তানের মুখে প্রথম হাসি, প্রথম হাঁটা, প্রথম ডাক। সবই মা-বাবার হৃদয়ে অমলিন স্মৃতি হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলামী দৃষ্টিতে সন্তান শুধু আবেগের বিষয় নয়, বরং এটি একটি আমানত।
এক পবিত্র দায়িত্ব, যার জবাবদিহি করতে হবে আল্লাহর দরবারে।
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেন যে তোমরা তোমাদের আমানতগুলো তাদের হকদারদের নিকট পৌঁছে দাও।’ (সুরা : আন-নিসা, আয়াত : ৫৮)
এই আয়াত শুধু সম্পদ বা দায়িত্বের ক্ষেত্রে নয়, বরং প্রত্যেকটি মানব সম্পর্কের আমানতকেও অন্তর্ভুক্ত করে। সন্তান সেই আমানত, যাকে আল্লাহ প্রকৃত মানুষ হিসেবে গঠনের জন্য আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই একজন রক্ষণাবেক্ষক এবং প্রত্যেকেই তার অধীনস্থদের ব্যাপারে জবাবদিহি করবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৮৯৩)
অতএব সন্তানের শিক্ষার ক্ষেত্রে অবহেলা করা মানে এই আমানতের প্রতি খেয়ানত করা।
ইসলামী দৃষ্টিতে শিক্ষার উদ্দেশ্য
ইসলামে শিক্ষা কোনো দুনিয়াবি প্রতিযোগিতা নয়; বরং এটি আত্মা ও বুদ্ধি উভয়কে পরিশুদ্ধ করার প্রক্রিয়া। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে, সে সফল হয়েছে।’ (সুরা : আশ-শামস, আয়াত : ৯)
এই পরিশুদ্ধতার শিক্ষা শুরু হয় শৈশবেই। যখন শিশু তার চারপাশের জগেক অনুকরণ করতে শেখে। ইসলামী শিক্ষার লক্ষ্য হলো, মানুষকে আল্লাহর পরিচয় করানো, নৈতিক মূল্যবোধ জাগানো এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঈমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভ্যস্ত করা।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো এবং তাদেরকে উত্তমরূপে সদাচার শিক্ষা দাও।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৬৭১)
এখানে শিক্ষা বলতে শুধু বর্ণমালা বা গণিত নয়; বরং আদব, আমানতদারিতা, সত্যবাদিতা, আল্লাহভীতি, নম্রতা ও দায়িত্ববোধ—এই গুণাবলির শিক্ষা বোঝানো হয়েছে।
প্রথম পাঠশালা হচ্ছে পরিবার
সন্তানের জন্য পরিবারের পরিবেশই প্রথম ও প্রধান বিদ্যালয়। শিশুর মন একখণ্ড সাদা কাগজের মতো। পিতা-মাতার কথাবার্তা, আচরণ, রাগ, মমতা—সব কিছুই সেই কাগজে দাগ কেটে যায়। ইমাম আল-গাজালি (রহ.) বলেছেন, ‘শিশু হলো এক মূল্যবান রত্ন। যদি তাকে কল্যাণের পথে শিক্ষা দেওয়া হয়, সে সৎ ও সফল মানুষ হবে। কিন্তু যদি অবহেলায় ফেলে রাখা হয়, সে ধ্বংসের পথে যাবে।’ (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, খণ্ড : ৩)
আধুনিক মনোবিজ্ঞানের গবেষণাও বলে, শিশুর নৈতিকতা ও আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপিত হয় জীবনের প্রথম সাত বছরে। এ সময় পিতা-মাতার ভালোবাসা ও শাসন উভয়ই প্রয়োজন, ভালোবাসা তাকে নিরাপত্তা দেয়, শাসন শেখায় সীমারেখা। মহানবী (সা.) নিজে ছিলেন সর্বোত্তম শিক্ষাদাতা। তিনি শিশুদের সঙ্গে হাসতেন, খেলতেন, কাঁধে তুলে নিতেন, কিন্তু একই সঙ্গে নৈতিকতা ও আল্লাহভীতি শেখাতেন।
নৈতিক শিক্ষার সূচনা
সন্তানের প্রতি ইসলামী শিক্ষার প্রথম ধাপ হলো, ঈমান ও তাওহিদের বীজ রোপণ করা। লুকমান (আ.) তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘হে আমার ছেলে! আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক কোরো না; নিশ্চয়ই শিরক মহা অন্যায়।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৩)
তারপর তিনি তাকে নামাজ কায়েম, অন্যায়ের প্রতিবাদ, ধৈর্য, অহংকার বর্জন ও নম্রতার শিক্ষা দিয়েছেন। এ উপদেশগুলোই ইসলামী শিক্ষার ভিত্তি। হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে নামাজ শেখাও; দশ বছর বয়সে না পড়লে তিরস্কার করো।’ (আবু দাউদ, হাদিস ৪৯৫)
এ শিক্ষা শুধু ধর্মীয় কর্তব্য নয়, বরং জীবনের শৃঙ্খলার সূচনা।
চরিত্র গঠনের দায়িত্ব
আজকের যুগে ‘স্মার্ট সন্তান’ গড়ার প্রতিযোগিতায় আমরা ভুলে যাচ্ছি ‘সৎ সন্তান’ গড়ার প্রয়োজন। সন্তানের হাতে মোবাইল, বিদেশি স্কুল, কোচিং—সব কিছু দিচ্ছি, কিন্তু তাদের হৃদয়ে আল্লাহভীতি ও পরোপকারের শিক্ষা দিচ্ছি না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো পিতা তাঁর সন্তানকে উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে বেশি উত্তম কোনো জিনিস দিতে পারে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৫২)
সচ্চরিত্র ছাড়া কোনো শিক্ষা পূর্ণতা পায় না। একজন চরিত্রবান সন্তান সমাজে ন্যায়, মানবতা ও ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কিন্তু চরিত্রহীন প্রতিভা সমাজকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যায়।
আমানতের অবহেলা ও সমাজের বিপর্যয়
আজ আমরা যে সমাজে বসবাস করছি, সেখানে মাদক, পর্নোগ্রাফি, হিংসা, আত্মহত্যা, অনৈতিকতা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। এই নৈতিক বিপর্যয়ের সূচনা হয় পরিবার থেকে, যখন সন্তানকে ‘মর্যাদাবোধ’ না শিখিয়ে ‘ভোগবাদ’ শেখানো হয়।
মা-বাবা যদি নিজেরাই নামাজ, পর্দা, সততা, দানশীলতার উদাহরণ স্থাপন না করেন, সন্তান কিভাবে তা শিখবে?
ইসলামে শেখানো হয়েছে, কথার চেয়ে কর্মের শিক্ষা বেশি কার্যকর। মহানবী (সা.) তাঁর সহধর্মিণী, সন্তান ও সাহাবিদের জীবনে এমন দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন যে তাঁর আচরণই ছিল জীবন্ত পাঠশালা।
ইসলামী শিক্ষার তিনটি স্তম্ভ
ইসলামী চিন্তাবিদ ও শিক্ষাবিদদের মতে, সন্তানের নৈতিক শিক্ষার তিনটি স্তম্ভ হলো—এক. আদব ও আচরণের শিক্ষা, দুই. ইবাদতের অভ্যাস গঠন, তিন. সমাজবোধ ও দায়িত্বশীলতা।
সন্তানকে শেখাতে হবে কিভাবে কথা বলতে হয়, কিভাবে অন্যের মতামতকে সম্মান করতে হয়, কিভাবে বড়দের সামনে ভদ্রতা বজায় রাখতে হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি প্রেরিত হয়েছি উত্তম চরিত্র পরিপূর্ণ করতে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৮৯৫২)
শিশুকে ছোটবেলা থেকেই নামাজ, রোজা, দোয়া শেখানো উচিত। এতে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হয়। সন্তানকে শেখাতে হবে, মানুষ একা নয়, সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব আছে। বৃদ্ধদের সম্মান, গরিবদের সাহায্য, প্রতিবেশীর হক— এসব ইসলামী শিক্ষার অংশ।
সন্তানের জন্য দোয়া ও আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা
পবিত্র কোরআনে দেখা যায় নেক পিতা-মাতারা সব সময় সন্তানদের জন্য দোয়া করেছেন। যেমন—‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের আমাদের চোখের শীতলতা দান করো এবং আমাদের মুত্তাকিদের ইমাম বানাও।’ (সুরা : আল-ফুরকান, আয়াত : ৭৪)
এই দোয়া শুধু মুখস্থ পড়ার জন্য নয়; এটি এক জীবনদর্শন। সন্তানকে নেক বানানোর জন্য পিতা-মাতাকে নিজেও নেক হতে হয়। কারণ আল্লাহর সাহায্য সেই পরিবারেই বর্ষিত হয় যেখানে ঈমান ও আমল বিদ্যমান।
আমানতদার পিতা-মাতার পুরস্কার
যে পিতা-মাতা সন্তানের মধ্যে ঈমান, কোরআন ও নৈতিকতার শিক্ষা দেন, আল্লাহ তাঁদের জন্য অশেষ পুরস্কার রেখেছেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সন্তানকে কোরআন শিক্ষা দেয়, কিয়ামতের দিন তাকে এমন পোশাক পরানো হবে, যার আলো সূর্যের চেয়েও দীপ্তিমান।’ (বায়হাকি, শু‘আবুল ঈমান, হাদিস : ২৪৮৪)
সন্তান এক মহান দায়িত্ব ও এক ঈমানি পরীক্ষা। পিতা-মাতার আমানতদারি শুধু খাওয়ানো-পরানো নয়, বরং আখলাক, আদব, ঈমান ও পরকাল সচেতনতার শিক্ষা দেওয়া ছাড়া সেই আমানতদারি রক্ষা হবে না।
মহান আল্লাহর নির্দেশ, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবারকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন মানুষ ও পাথর।’ (সুরা : তাহরিম, আয়াত : ৬)
এই আয়াতেই পিতা-মাতার দায়িত্বের পরিপূর্ণ সারমর্ম নিহিত। সন্তান আল্লাহর দান, কিন্তু সেই দান রক্ষা করাও এক আমানত। যে পিতা-মাতা এই আমানত রক্ষা করতে পারেন, তাঁরা শুধু ভালো অভিভাবক নন, তাঁরা দুনিয়া ও আখিরাতে সফল মানুষ।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের তাওফিক দান করুন।
লেখক : প্রবন্ধিক ও অনুবাদক
[email protected]
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন