শুরু হলো মুসলমানের আবেগ ও ভালোবাসার মাস রবিউল আউয়াল। এই মাসে পৃথিবীতে আলোকোজ্জ্বল এক সুবেহ সাদিক উদিত হয়েছিল, জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রেষ্ঠতম মানব, সবচেয়ে মর্যাদাবান রাসুল প্রিয় নবী মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ (সা.)। তিনি মানবজাতির প্রতি আল্লাহর করুণা ও দান, দয়া ও ভালোবাসা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এই অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে বলেন, ‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের কাছে রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাঁর আয়াতগুলো তাদের কাছে তিলাওয়াত করে, তাদেরকে পরিশোধন করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়, যদিও তারা আগে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল।’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৬৪)
তিনি সেই মহান রাসুল, যাঁর মাধ্যমে আল্লাহ মুমিনদের আত্মা পরিশুদ্ধ করেছেন, তাদের মন ও জীবন পবিত্র করেছেন এবং তিনি ছিলেন মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘হুজ্জত’ (প্রমাণ) স্বরূপ। আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে নিজের শাশ্বত জীবনবিধানকে পূর্ণতা দান করেছেন। ফলে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর একত্ববাদ, দ্বিন ও শরিয়তের প্রমাণ নিয়ে আর কোনো নবী বা রাসুলের আগমন ঘটবে না। আর নিয়ে আসা দ্বিন ও শরিয়ত চর্চা করা হবে কিয়ামত পর্যন্ত।
আল্লাহ বলেন, ‘মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসুল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৪০)
মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম হয়েছিল এক বরকতময় সূচনা হিসেবে। তাঁর প্রেরণায় ছড়িয়ে পড়ে এক আলো, যে আলো মানুষকে বিভ্রান্তি থেকে হেদায়েতে, অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানে, বিপথগামিতা থেকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনে।
আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে অন্ধের চোখ, বধিরের কান ও বন্ধ-হৃদয় ব্যক্তির অন্তরকে উন্মুক্ত করেন। বস্তুত তিনি সমগ্র মানবজাতিকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের কিনার থেকে উদ্ধার করেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো : তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ তা থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন।’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)
আল্লাহ তাঁকে এমন গুণে গুণান্বিত করেছিলেন এবং এমন ঘনিষ্ঠতা দান করেছিলেন যে তাঁর আনুগত্যকে নিজের আনুগত্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন এবং তাঁর ভালোবাসাকে ঈমানের অপরিহার্য অংশ ঘোষণা করেছেন।
আল্লাহ বলেন, ‘যে রাসুলের আনুগত্য করল সে আল্লাহরই আনুগত্য করল।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৮০)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ পূর্ণ ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার সন্তান, পিতা ও সব মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫)
তিনি ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী, সর্বোচ্চ নৈতিকতার বাস্তব রূপ। ছিলেন সর্বাধিক বিশ্বস্ত, সত্যবাদী, উদার ও দানশীল, ধৈর্যে অদ্বিতীয়, ক্ষমায় অতুলনীয়। আল্লাহ তাঁর বক্ষ প্রশস্ত করেছেন, তাঁর স্মরণ উচ্চ করে দিয়েছেন ও তাঁর বোঝা দূর করেছেন। আল্লাহ তাঁকে কোনো সময় ত্যাগ করেননি, তাঁকে ঘৃণা করেননি, বরং তাঁকে পথ দেখিয়েছেন, অভাবমুক্ত করেছেন এবং আশ্রয় দিয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে দুনিয়ায় স্থায়ী জীবন আর নিজের কাছে ফিরে যাওয়ার মধ্যে পছন্দ করার সুযোগ দিয়েছেন, কিন্তু আল্লাহর সাক্ষােকই বেছে নেন। তিনিই হবেন প্রথম ব্যক্তি, যাঁর জন্য জান্নাতের দরজা খোলা হবে। ইসলামের কবি হাসান ইবনে সাবিত (রা.) তাঁর প্রশংসা করে বলেন, ‘আমার চোখ কখনো তোমার চেয়ে উত্তম কাউকে দেখেনি, কোনো নারী তোমার চেয়ে সুন্দর কাউকে জন্ম দেয়নি, তুমি সৃষ্টি হয়েছ ত্রুটিমুক্ত অবস্থায়, যেন তুমি এমনভাবে সৃষ্টি হয়েছ, যেমন তুমি চেয়েছ।’
(আর-রাসুলুল ইনসান, পৃষ্ঠা-২৫২)
মহানবী (সা.)-এর প্রেরণের আগে আরবরা ছিল চরম অন্ধকারাচ্ছন্ন, যারা বাস করত এক জাহেলি যুগে। পৃথিবীতে তাদের জীবনযাপন ছিল পশুর মতো। তারা মৃত জন্তুর মাংস খেত, কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিত, শক্তিশালী দুর্বলকে চেপে ধরত। আল্লাহ চাইলেন রাত দূর হোক, প্রভাতের আলো ফুটুক, আঁধার কাটিয়ে আলো ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র। ফলে দয়ার নবী, মায়ার নবী, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রেরণ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের কাছে এক রাসুল এসেছে। তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তা তার জন্য কষ্টদায়ক। সে তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি সে দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১২৮)
সুতরাং কেউ যদি পৃথিবীতে অন্ধকার থেকে মুক্তি চায় এবং আলোর দেখা পেতে আগ্রহী হয়, তবে তাঁকে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পথ অনুসরণ করতে হবে। মদিনার প্রেমিক ইমাম মালেক বিন আনাস (রহ.) বলতেন, ‘সুন্নত হলো নুহ (আ.)-এর নৌকার মতো। যে তাতে আরোহণ করবে সে মুক্তি পাবে আর যে তাতে আরোহণ করবে না সে ধ্বংস হয়ে যাবে। এই উম্মতের শেষ প্রজন্মের কল্যাণ সে পথেই নিহিত যে পথে তার প্রথম প্রজন্ম কল্যাণ লাভ করেছে।’ (তারিখে দামেশক : ৯/১৪)
মানুষ কিভাবে বিমুখ থাকতে পারে সেই মহান ব্যক্তিত্ব থেকে, যাকে আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত এবং মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ করেছেন। যার ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহর সাক্ষ্য হলো, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মধ্যে আছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ২১)
এর পরও যে হতভাগ্য নবী মুহাম্মদ (সা.) থেকে বিমুখ থাকবে তার জন্য আল্লাহর হুঁশিয়ারি হলো, ‘সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে বিপর্যয় তাদের ওপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের ওপর মর্মন্তুত শাস্তি।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৬৩)
হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মদ (সা.), তাঁর পরিবার-পরিজন ও অনুসারীদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন এবং আমাদেরকে তাদের অনুসারী হিসেবে কবুল করুন। আমিন।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন