৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের পর প্রথমে আত্মগোপনে চলে যান হারুন। অবশ্য ১ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতন আঁচ করতে পেরে তার পরিবারের সদস্যদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেন হারুন। আগস্টের শেষ দিকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যান তিনি। পরে মার্কিন পাসপোর্ট দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে সপরিবার বসবাস করছেন। সেখানে তার একাধিক ব্যবসা রয়েছে বলে জানা গেছে।
দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থে যুক্তরাষ্ট্রে বিলাসী জীবনযাপন করছে হারুনের পরিবার। এ ছাড়া বিশ্বের অন্তত ছয়টি দেশে রয়েছে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সৌদি আরবের জেদ্দায় কথিত মামা জাহাঙ্গীরের এক বন্ধুর মাধ্যমে একটি আবাসিক হোটেলে বিনিয়োগ করেছেন। এ ছাড়া দুবাইয়ে একটি পাঁচ তারকা হোটেল, এডিসি সাইফুলের ভাই রিফাতের সঙ্গে স্বর্ণের ব্যবসাসহ নামে-বেনামে রয়েছে অসংখ্য সম্পদ। হারুনের স্ত্রী ২০০৭ সালের দিকে ডিবি ভিসায় আমেরিকায় পাড়ি জমান। এর কিছুদিন পর হারুনও সেখানে যান। নথিপত্র বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও রয়েছে হারুনের। আছে সে দেশের পাসপোর্টও। তিনি বাংলাদেশের সরকারি পাসপোর্ট ব্যবহার না করে সাধারণ পাসপোর্ট ব্যবহার করেই বিদেশে ভ্রমণ করেন।
সূত্র বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের নিউ হাইড পার্ক এলাকায় স্ত্রীর নামে ৫ মিলিয়ন ডলারে একটি বাড়ি কিনেছেন হারুন। ওই সময় হারুনের স্ত্রীর বিপুল অর্থ লেনদেন শনাক্ত করে এর তদন্ত করেছিল এফবিআই। যুক্তরাষ্ট্রে তার স্ত্রীর নামে একটি ব্যাংকে থাকা ১ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা এফবিআইয়ের সুপারিশে আটকা পড়েছে। সে টাকা এখনো উদ্ধার করতে পারেননি হারুন অর রশীদ। তবে তাতে হারুনের খুব একটা সমস্যা হয়নি। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে নামে- বেনামে তার রয়েছে বিপুল সম্পদ। পরিকল্পিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচার করেছে হারুন। উল্লেখ্য, হারুন এবং তার স্ত্রী দুজনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। কাজেই সেখানকার আইনের ফাঁকফোকর দিয়েই টাকা পাচার করেছেন হারুন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হারুন সরাসরি বাংলাদেশ থেকে টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছেন খুবই কম। অন্তত ছয়টি দেশে হারুনের পাচার হওয়া টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এসব দেশ থেকে টাকা বৈধ উপায়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। বিদেশে অর্থ পাচারের সুবিধার জন্য হারুন গড়ে তোলেন নিজস্ব মানি এক্সচেঞ্জ। পুরানা পল্টনের আজাদ প্রোডাক্টসের গলিতে এর ঢাকার অফিস। এর শাখা আছে দুবাই, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর এবং ইস্তাম্বুলে। এই মানি এক্সচেঞ্জের আড়ালে হারুন টাকা পাচার করতেন। এই মানি এক্সচেঞ্জ পরিচালনা করতেন সাবেক এডিসি সাইফুল ইসলামের দুই ভাই। একজন থাকতেন দেশে। আরেক ভাই রিফাত অবস্থান করেন দুবাই। দুবাইয়ে তার স্বর্ণের ব্যবসাও আছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরও অন্তত পাঁচটি দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ আছে হারুনের। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে হারুনের একাধিক সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। দুবাই এবং শারজায় হারুনের দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে। শারজায় তার একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এ ছাড়াও দুবাইতে আছে তার মানি এক্সচেঞ্জ। মালয়েশিয়ায় হারুনের সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। হারুন এবং তার স্ত্রী দুজনেই সেখানে সেকেন্ড হোম স্কিমে বিনিয়োগ করেছেন। মালয়েশিয়াতে তাদের একটি মানি এক্সচেঞ্জ রয়েছে। কুয়ালালামপুরে আছে তাদের রেস্তোরাঁ। সিআইডির একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সুইজারল্যান্ডের একটি ব্যাংকে হারুনের অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তবে সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে খোলা। এ কারণেই সেই অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তুরস্কে হারুনের বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। হারুন বিনিয়োগকারী হিসেবে সে দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন বলেও জানা গেছে। দেশটির বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ডাটাবেসে হারুনের নাম রয়েছে। এভাবেই পুলিশের চাকরি করে দুর্নীতি আর লুটপাটের মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে তার বেশির ভাগই বিদেশে পাচার করেছেন এই দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এবং তার স্ত্রী ও ভাইয়ের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাগুলো করা হয়। মামলার এজাহারে সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে ১৭ কোটি ৫১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ, তার স্ত্রী শিরিন আক্তারের বিরুদ্ধে ১০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং হারুনের ভাই এ বি এম শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে ১২ কোটি ৯৬ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের আদালত দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে হারুনের ১০টি ও শাহরিয়ারের ১১টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। জব্দ হওয়া স্থাবর সম্পদের মধ্যে হারুনের নামে ঢাকার উত্তরায় ৭ দশমিক ৪৫ কাঠা জমিতে ৩ কোটি টাকা মূল্যের একটি ইমারত রয়েছে। গুলশানে ১০ দশমিক ৩৬ শতক জমিতে ৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকার আরেকটি ইমারত রয়েছে। এ ছাড়া সেমিপাকা একটি টিনশেড বাড়ি, খিলক্ষেতে একতলা একটি দালান ও সেমিপাকা আরেকটি টিনের বাড়ি রয়েছে। হারুনের নামে উত্তরায় ১০ নম্বর সেক্টরে সাত তলা ভবনে দ্বিতীয় তলায় একটি ফ্ল্যাট ও জোয়ারসাহারায় ছয় তলা ভবনের ছয়তলায় আরেকটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এই দুই ফ্ল্যাটসহ আশিয়ান সিটিতে হারুনের নামে ৫ কাঠার একটি প্লট রয়েছে। পাশাপাশি শাহরিয়ারের তিনটি কোম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধ হয়েছে। ডিবি হারুনের বিষয়ে আবেদনে বলা হয়েছে, আসামি মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ ১৭ কোটি ৫১ লাখ ১৭ হাজার টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনপূর্বক ভোগ-দখলে রাখার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। আসামি তার মালিকানাধীন ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন, যা করতে পারলে এ মামলা আদালত কর্তৃক বিচার শেষে সাজার অংশ হিসেবে অপরাধলব্ধ আয় হতে অর্জিত সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্তকরণসহ সব উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে স্থাবর সম্পত্তিগুলো জব্দ ও অস্থাবর সম্পত্তিগুলো অবরুদ্ধ করা একান্ত প্রয়োজন। দেশে তার সম্পদ জব্দ হলেও বিদেশে হারুনের সম্পদ ধরাছোঁয়ার বাইরে।