সবুজে ঘেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শুধু উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় নয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য- সংস্কৃতির এক আঁতুড়ঘর হিসেবেও পরিচিত। এ ক্যাম্পাসে অবস্থিত দেশের সবচেয়ে উঁচু শহীদ মিনার। এটি একাধারে স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন, ভাষা আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের প্রতীক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই দূর থেকে গাছগাছালির ফাঁকে চোখে পড়ে লালচে রঙের সুউচ্চ শহীদ মিনারটি। নতুন কলা ও মানবিক অনুষদের সামনে অবস্থিত এ শহীদ মিনারটি দর্শনার্থী ও শিক্ষার্থীদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ কেন্দ্র।
৭১ ফুট উচ্চতার এ শহীদ মিনার বর্তমানে দেশের সবচেয়ে উঁচু শহীদ মিনার হিসেবে পরিচিত। এর উচ্চতা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সম্মান জানিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া, শহীদ মিনারের ভিত্তিমঞ্চের ৫২ ফুট ব্যাস ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গৌরবগাথাকে স্মরণ করে করা হয়। শহীদ মিনারের ভিত্তিমঞ্চে রয়েছে আটটি সিঁড়ি। যা ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে আটটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ ও ১৯৭১-এর প্রতিনিধিত্ব করে। পৃথক তিনটি স্তম্ভের মধ্যে প্রথমটি বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি; দ্বিতীয়টি মাটি ও মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ; আর তৃতীয়টি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক।
দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাসের সাক্ষী এ শহীদ মিনার প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে আল বেরুনী হলের সামনে নির্মিত হয়। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ ফ ম কামালউদ্দিনের সময় শহীদ মিনারটি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে স্থানান্তর করা হয়। ২০০৪ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান বর্তমান মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ২০০৬ সালে উদ্বোধন করেন। স্থপতি রবিউল হোসাইনের নকশায় নির্মিত এই লাল ইটের স্থাপত্য এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় বহন করে। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারের বেদিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ পরিপাটি করে সাজানো হয়। শিক্ষার্থীদের আড্ডা, গান, কবিতা ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এ স্থানটি। তবে শিক্ষার্থীরা মনে করেন, শহীদ মিনারের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষায় সবার আরও সচেতন হওয়া উচিত। সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সাকিব হাওলাদার বলেন, ‘সুউচ্চ এ শহীদ মিনারটির মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। এটি বাংলাদেশের অতীতে সংঘটিত হওয়া বড় বড় আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতীক। এখনো ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা যে কোনো যৌক্তিক দাবি আদায়ের আন্দোলনের শুরুটা এ শহীদ মিনার থেকে করে। এ শহীদ মিনার চত্বরে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। জাবির এ শহীদ মিনার জুলাই আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের স্মৃতিও বহন করে।’ ক্যাম্পাসটিতে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য ও ভাস্কর্য রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘অমর একুশে’ ভাস্কর্য ও ‘সংশপ্তক’, ‘অদম্য ২৪’। ‘অমর একুশে’ ভাস্কর্যে ভাষা আন্দোলনে নিহত সন্তানের লাশ বুকে ধারণ করা মায়ের বেদনাময় মুহূর্ত ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী জাহানারা পারভীন। ১৯৯১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক কাজী সালেহ আহমেদ এ ভাস্কর্যের উদ্বোধন করেন। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের অদম্য চেতনা ধারণ করে নির্মিত ‘সংশপ্তক’ ভাস্কর্যটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের নির্মিত ১৫ ফুট উঁচু এই ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যে দেখা যায় এক পা ও এক হাত হারিয়েও রাইফেল হাতে লড়াইরত এক মুক্তিযোদ্ধা, যিনি প্রতীক হয়ে আছেন চূড়ান্ত আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের। ‘অদম্য ২৪’ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জুলাই-আগস্ট আন্দোলন চলাকালে নিহতদের স্মরণে এ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়। জাবির পুরোনো ফজিলাতুন নেছা হলের সামনে অবস্থিত এ স্মৃতিস্তম্ভের স্থপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রাঈদ হোসেন। স্মৃতিস্তম্ভটি জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করে।