দেশের মাদরাসাগুলো ঈদুল আজহার সময় কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করে থাকে। অতীতে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করে মাদরাসাগুলো সন্তোষজনক পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করতে পারত; কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য কমতে থাকে। আর্থিকভাবে যা ছিল দেশের দ্বিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বড় ধরনের একটি আঘাত। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই আঘাত কাটিয়ে উঠতে চায় দ্বিনি মাদরাসাগুলো।
তারা চায় এবার যেন পশুর চামড়ার ন্যায্য মূল্য পাওয়া যায় এবং চামড়া সংগ্রহের পরিবেশ অনুকূল থাকে।
বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হকের কাছে কাঁচা চামড়ার ধারাবাহিক মূল্যপতনের কারণ জানতে চেয়েছিলাম। উত্তরে তিনি বলেন, ‘এক সময় আমরা মাদরাসার জন্য সংগৃহীত চামড়া সাড়ে তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৮০০ টাকায়ও বিক্রি করেছি। বড় চামড়ার মূল্য আরো বেশি পাওয়া গেছে।
কিন্তু গত বছর কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে শুধু ৮০০ টাকায়। কাঁচা চামড়ার এই ধারাবাহিক মূল্যপতনের পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত অপরিকল্পিতভাবে এবং যথেষ্ট প্রস্তুতি ছাড়াই হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিশিল্পকে হেমায়েতপুর নিয়ে যাওয়া এবং হাজারীবাগের কারখানা বন্ধ করে দেওয়া। এতে অনেক ব্যবসায়ীই ব্যবসার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেননি।
অনেকেই বিশ্বাস করেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতেই দেশের চামড়াশিল্পকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। আর বিগত সরকার যেহেতু ভারতনির্ভর ছিল, তাই এমন ধারণা খুব বেশি অমূলকও নয়। পাশাপাশি এর মাধ্যমে দেশের দ্বিনি মাদরাসাগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করার দূরভিসন্ধি থাকাটাও অসম্ভব কিছু নয়।’
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীও কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্যপতনের জন্য বিগত সরকারকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে পতিত সরকার বাংলাদেশের সব সেক্টরকে যেভাবে ধ্বংস করেছে, চামড়াশিল্পকেও সেভাবে ধ্বংস করে গেছে। প্রশাসনের সহযোগিতায় একটি সিন্ডিকেট চামড়াশিল্পকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করেছে।’
তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা বিগত সরকারের আমলে বারবার সরকার ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। বিভিন্ন ব্যানারে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আলোচনা করেছি, প্রতিবাদ জানিয়েছি, কিন্তু তারা আমাদের কথা আমলে নেয়নি। এবার সুযোগ এসেছে চামড়াশিল্পকে উদ্ধার করার এবং মাদরাসাগুলোর স্বার্থ রক্ষা করার। সরকার চামড়ার ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে পারলে এবং ন্যায্য মূল্যে চামড়া বিক্রি করা গেলে মাদরাসাগুলো উপকৃত হবে। এতে প্রকারান্তে অসহায় ও গরিব মানুষই উপকৃত হবে। দেশের চামড়াশিল্পও রক্ষা পাবে।’
মাওলানা আফেন্দী মাদরাসাগুলোর জন্য পশুর চামড়ার ন্যায্য মূল্য পাওয়ার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘চামড়া খাতের আয় থেকে দেশের কওমি মাদরাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিংগুলোর ব্যয়ের একটি বড় অংশ নির্বাহ করা হয়। লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে সাধারণত খায় গরিব, দুঃখী ও দুস্থ মানুষের সন্তানরা। যারা নিজ খরচে লেখাপড়া করতে অক্ষম। কোরবানির পশুর চামড়া থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে তাদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হয়। সুতরাং চামড়ার মূল্য কমিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো গরিব মানুষের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। আমরা বিষয়টিকে এভাবেই দেখি।’
মাওলানা মাহফুজুল হকের বক্তব্যে উঠে এসেছে চামড়ার মূল্যপতনে মাদরাসাগুলো কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে চিত্র। তিনি বলেন, ‘কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্যপতনে কওমি মাদরাসাগুলোর ওপর বেশ বড় ধাক্কাই লেগেছে। কয়েক বছর এমন হয়েছে, ঢাকা শহরে পশুর চামড়ার ন্যূনতম মূল্য পাওয়া গেলেও গ্রামে কোনো মূল্যই পাওয়া যায়নি। মাদরাসাগুলোর জন্য খরচ ওঠানোই কঠিন ছিল। এমনকি কোরবানির পশুর চামড়া নদীতে ফেলে দেওয়া এবং মাটিতে পুঁতে ফেলার মতো দৃশ্যও আমরা দেখেছি। দ্বিনি মাদরাসাগুলো সরাসরি আল্লাহর অনুগ্রহে পরিচালিত হয় বলে হয়তো পরিস্থিতি সামলে নেওয়া গেছে, কিন্তু তারা যে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’
পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মাদরাসাগুলো পরিস্থিতির উন্নয়ন চায়। মাওলানা মাহফুজুল হক তাদের প্রত্যাশা তুলে ধরে বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে এবার মাদরাসাগুলোর প্রত্যাশা বেশিই। মাদরাসাগুলো চায় এবার যেন তারা কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্য মূল্য পায়। একবারেই হয়তো চামড়ার মূল্য আগের জায়গায় যাবে না, কিন্তু বৃদ্ধির সূচনা যেন হয়। ৮০০ টাকা থেকে মধ্যম সাইজের চামড়ার মূল্য যেন দেড় হাজার টাকা হয়। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও যেন ভালো থাকে।’
মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘অতীতে আমরা দেখেছি, সরকারদলীয় যুব ও ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা কোরবানির পশুর চামড়া কেড়ে নিত, স্বল্পমূল্যে তা বিক্রি করতে বাধ্য করত; সর্বোপরি মাদরাসার চামড়া সংগ্রহের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করত। এই খারাপ দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না বলেই আমরা আশা করি। সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সব দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে বলব, আগের খারাপ জায়গায় যেন আমরা ফিরে না যাই।’
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রায় একই কথা বলেন মাওলানা মাহফুজুল হক—‘অতীতে যখন কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য বেশি ছিল, তখন মাঠ পর্যায়ে চামড়া সংগ্রহের ক্ষেত্রে মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা নানা ধরনের প্রতিকূলতার শিকার হয়েছে। একটি সংগঠনের ছাত্র ও যুব শাখার কর্মীরা নানাভাবে সমস্যা তৈরি করেছে। আমরা আশা করি, এবার তেমনটি হবে না।’
তিনি সরকার ও প্রশাসনকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘প্রশাসন কিছুটা তৎপর থাকলে মাঠ পর্যায়ের সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। অতীতে শুধু মাদরাসার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাই সমস্যার সম্মুখীন হয়নি, বরং যিনি মাদরাসায় তাঁর কোরবানির পশুর চামড়া দান করতে চাইতেন তাঁকে হেনস্থা করা হয়েছে, যা কিছুতেই কাম্য নয়। বর্তমান সরকারের কাছে প্রত্যাশা থাকবে, তারা যেন পর্যাপ্ত পুলিশ নিয়োগের মাধ্যমে দ্বিনি মাদরাসাগুলোর স্বার্থ রক্ষা করে। তাদের মনে রাখতে হবে, যে আন্দোলনের কারণে তারা ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে তাতে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ও অবদান ছিল।’
মাওলানা আফেন্দী মনে করেন পশুর চামড়ার ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও নৈতিক দায় আছে। তাঁর ভাষায়—‘ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের প্রতিও আহবান থাকবে, তাঁরা যেন উদার মনোভাব নিয়ে মাদরাসার চামড়ার ন্যায্য মূল্য প্রদান করেন এবং সিন্ডিকেট করে চামড়ার দরপতন না ঘটান।’
উভয় আলেম কোরবানির পশুর চামড়া বা তার মূল্য দান করার ক্ষেত্রে দ্বিনি মাদরাসাগুলোকে প্রাধান্য দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন, ‘সর্বশ্রেণির মানুষের প্রতি আমাদের আহবান থাকবে, তারা যেন কোরবানির পশুর চামড়া মাদরাসায় দান করেন, বিশেষত যেখানে লিল্লাহ বোর্ডিং আছে। কোরবানির চামড়া যেকোনো অসহায় মানুষকে দান করা যায়। তবে মাদরাসায় দিলে দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করার পাশাপাশি সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে দ্বিনি শিক্ষা প্রসারে সহযোগী হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন