ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ক্যাম্পাসজুড়ে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। আচরণবিধি লঙ্ঘন নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে শুরু হয়েছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। এ ছাড়া প্রশাসনের নতুন সিদ্ধান্তে ভোগান্তিতে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল নির্বাচন ঘিরে সাইবার বুলিং নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশন জানায়, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা এবং সাইবার বুলিং প্রতিরোধের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। এনিয়ে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিটিআরসি চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। এতে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ-১’ ও ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ-২’-সহ আরও কয়েকটি চিহ্নিত অনলাইন পেজ অনতিবিলম্বে বন্ধ করে আগামী ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা বলবৎ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মত প্রকাশ ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ -১’ ও ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ-২’। ফলে প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তকে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ মনে করছেন তারা। নিয়মতান্ত্রিকভাবে এসব গ্রুপ নির্বাচনের সময় সচল রাখার দাবি তাদের।
এ ছাড়া ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ পরিবহন সেবা ‘শাটল সার্ভিস’ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গত শনিবার ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. জসীম উদ্দিনের ‘গ্রিন ফিউচার ফাউন্ডেশন’-এর চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে বন্ধ রাখার কথা জানানো হয়। যার ফলে গতকাল থেকে বন্ধ হয়ে যায় সেবা।
নির্বাচন কমিশনের এমন সিদ্ধান্তে ভোগান্তিতে পড়েছেন কবি সুফিয়া কামাল হল, কুয়েত মৈত্রী হল ও ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তের নিন্দা জানান তারা। অনতিবিলম্বে তারা এ নির্দেশ প্রত্যাহারের দাবি জানান।
এ ব্যাপরে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, ‘এটার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা আছে তারাও নির্বাচনের প্রার্থী। তাই এটি ভোটকে ও ভোটারকে প্রভাবিত করতে পারে। সেজন্য আপাতত বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।’
এদিকে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুশলবিনিময়ের অভিযোগ জমা পড়েছে ছাত্রদল মনোনীত ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে। আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন ডাকসু নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক জসীম উদ্দীন।
তিনি বলেন, ‘অভিযোগ পেয়েছি, আমরা কমিশনের সদস্যদের ডাকব, উনারা সিদ্ধান্ত নেবেন তাকে সতর্ক করবেন, না করবেন না। এরপর আমরা কমিশনের সিদ্ধান্ত তাকে জানিয়ে দেব।’
জানা গেছে, গত শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলের পাঠকক্ষে প্রবেশ করে অধ্যয়নরত একাধিক শিক্ষার্থীর কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে, দোয়া-সমর্থন চান এবং কয়েকজনের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনি বিধিমালা অনুযায়ী, শ্রেণিকক্ষ, পাঠকক্ষ, পরীক্ষার হলসহ পাঠদান বা অধ্যয়ন ব্যাহত হতে পারে- এমন স্থানে সভা/সমাবেশ বা নির্বাচনি প্রচারণা করা যাবে না। আর বিধিমালা-১৭ অনুযায়ী, আচরণবিধি ভঙ্গের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা জরিমানা, প্রার্থিতা বাতিল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার বা আইন অনুযায়ী অন্যান্য দণ্ডের বিধান আছে।
গতকাল দুপুরে ব্যবসায় অনুষদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুশলবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে শিবির সমর্থিত সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবির সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন খান বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন উপলক্ষে এক ধরনের সাজ-সাজ আমেজ বিরাজ করলেও নির্বাচন কমিশনের নমনীয় আচরণের কারণে কিছু প্যানেল ও প্রার্থীরা নিয়মিত আচরণবিধি লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন। দলবদ্ধ হয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন, শিক্ষার্থীদের রিডিং রুমে পর্যন্ত চলে যাচ্ছেন। আমরা জানানোর পরও কমিশন আচরণবিধিগুলো লঙ্ঘনের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আশা করি, কমিশনের পক্ষে যে ধরনের নির্দেশনা ছিল তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে যারা আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’
এদিকে আট দফা দাবিতে কমিশনকে স্মারকলিপি দেয় ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল। এ প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী আল সাদী ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ নির্বাচন কমিশনের কাছে কোনো অভিযোগ এলে তারা শুধু প্রার্থীদের আশ্বাস দেয়। আমরা এমন ‘আশ্বাস’-কমিশন চাই না। এ ছাড়া একটি অপশক্তি ডাকসু বানচালের চেষ্টা করছেন। আমরা স্পষ্টত বলতে চাই, কেউ যদি ডাকসু বানচালের চেষ্টা করেন, শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিহত করবে এবং যে কোনো মূল্যে ডাকসু হবে, সেটি ৯ সেপ্টেম্বরেই হবে।’
এ বিষয়ে গতকাল বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি উঠলে লঙ্ঘন হয়নি বলে দাবি করে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে বলব শিবির ও বাগছাসের পরামর্শ অনুযায়ী এমন একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হোক, যাতে ভিপি ও জিএস প্রার্থীদের শিকল দিয়ে বেঁধে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখা যায়। কারণ, প্রার্থীরা বাইরে বের হলে শিক্ষার্থীরা সালাম দেবে, কথা বলবে, এটিও যদি আচরণবিধি লঙ্ঘন হয়, তাহলে শিকলেই বন্দি থাকা ভালো।’
এর আগে দুপুরে বিজয় একাত্তর হলে কুশলবিনিময় করতে আসেন ছাত্রদল প্যানেলের প্রার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীদোর সঙ্গে ক্যান্টিনে খাবারও খান। খাওয়া শেষে সাংবাদিকদের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা আগে মজলুম ছিলাম। ৫ আগস্ট পরবর্তী এই এক বছরেও ঢাবি ক্যাম্পাসে আমরা মজলুম আছি।’
অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘হলগুলোতে আমাদের নারীদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হচ্ছে। হুমকি দেওয়া হচ্ছে, ছাত্রলীগের আতিকাকে যেভাবে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে আমাদের নারী নেতা-কর্মীদেরও নাকি সেভাবে বের করে দেওয়া হবে।’
ছাত্রদলের জিএস পদপ্রার্থী তানভীর বারী হামিম বলেন, ‘প্রত্যেকটা সংগঠন আমাদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ এনেছে। অথচ আমরা দেখেছি আচরণবিধি ভঙ্গ করে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য গতকাল টিএসসিতে স্ট্যান্ড আপ কমেডি করেছে। আমরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি।’
প্রার্থীদের ডোপ টেস্টের দাবি : মাদকমুক্ত নেতৃত্ব নিশ্চিতে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের ডোপ টেস্টের দাবি জানিয়েছে চার সদস্যবিশিষ্ট আংশিক প্যানেলের সমাজসেবা সম্পাদক পদপ্রার্থী এবি জুবায়ের। গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান তিনি।
নির্বাচনের পর পরীক্ষা নেওয়ার অনুরোধ শিবির-বামদের : চলমান বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের সেমিস্টার ফাইনাল ও মিডটার্ম পরীক্ষাগুলো নির্বাচনের পর নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ও বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলো। গতকাল দুপুরে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের শিবির সমর্থিত প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের’ ভিপি প্রার্থী আবু সাদিক কায়েম বলেন, ‘অনেক ডিপার্টমেন্টে পরীক্ষা চলমান। আবার কিছু ডিপার্টমেন্টে পরীক্ষা নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত হবে। এতে করে শিক্ষার্থীরা আনন্দমুখর পরিবেশটা উপভোগ করতে পারছে না। তাই প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করব এ পরীক্ষাগুলো পিছিয়ে ডাকসু নির্বাচনের পরে নিলে শিক্ষার্থীরা নির্বাচনকে ভালোভাবে উপভোগ করতে পারবে।’ এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একই দাবি জানান বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের প্যানেল ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’। লিখিত বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদপ্রার্থী মোজাম্মেল হক বলেন, ৫-১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব পরীক্ষা স্থগিত রেখে কেবল ক্লাস চালু রাখতে হবে। এর ফলে প্রার্থীরা পড়াশোনা ও নির্বাচনের মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নিতে বাধ্য হবেন না। আর ভোটাররা যথাযথভাবে প্রার্থীদের যাচাই-বাছাইয়ের সময় পাবেন।’
আপিলের প্রার্থিতা ফিরে পাচ্ছেন ৩৪ জন, প্রার্থিতা বাতিলে দুজনের সুপারিশ : তথ্যে বিভ্রান্তি থাকায় ৪৭ প্রার্থীর প্রার্থিতা স্থগিত করা হয়। স্থগিতের পরে প্রার্থিতা ফিরে পেতে ৩৪ জন আপিল করেন। আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে প্রার্থিতা ফিরে পাচ্ছেন তারা। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ডাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘আমরা তথ্য বিভ্রান্তির কারণে কিছু সংখ্যক প্রার্থীর প্রার্থিতা স্থগিত রেখেছিলাম। পরে আপিল করার সময় দেওয়া হলে, ৩৪ জন আপিল করলে সেগুলো আপিল নিষ্পত্তি বোর্ডে পাঠিয়ে দিই। আমরা আন-অফিশিয়ালি জানতে পেরেছি আপিলকারীদের পক্ষে রায় হয়েছে। আশা করছি, শিগগিরই তা অফিশিয়ালি ঘোষণা করা হবে।’
এদিকে স্বতন্ত্র ভিপি (সহসভাপতি) পদপ্রার্থী ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মো. জুলিয়াস সিজার তালুকদার এবং নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের আরেক নেতা বায়েজিদ বোস্তামীর প্রার্থিতা বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডাকসু নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘এটি উচ্চতর কমিটি। এ কমিটির সুপারিশ আমরা মানতে বাধ্য। ফলে পূর্ণ কমিশন বসে এই দুজনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
ছয় দাবিতে নির্বাচন কমিশনে বামপন্থি প্যানেলের স্মারকলিপি প্রদান : সংবাদ সম্মেলন শেষে অপরাধে সম্পৃক্তদের প্রার্থিতা বাতিল, পরীক্ষা সাময়িক স্থগিতসহ ছয় দাবিতে ডাকসু ও হল সংসদ প্রধান নির্বাচন কমিশনকে স্মারকলিপি দেয় প্রতিরোধ পর্ষদ। দাবিগুলো হলো- অপরাধে সম্পৃক্তদের প্রার্থিতা বাতিল, পরীক্ষা সাময়িক স্থগিত, ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি ও স্থানান্তর, আচরণবিধি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন, ব্যালটে ছবি সংযুক্তকরণ এবং ভোটদান প্রক্রিয়া সহজ করা।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইলে ভোটদানের ব্যবস্থা, ইচ্ছুকদের আবেদনের আহ্বান : নির্বাচনে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইলে ভোটদানের ব্যবস্থা করা হবে। তবে ব্রেইলে ইচ্ছুকদের করতে হবে আবেদন। গতকাল সন্ধ্যায় এক বিজ্ঞপ্তিতে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিনের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।