কী ঘটেছে কুমিল্লার মুরাদনগরে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ভিডিওটি দেখে অনেকেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এতে এক নারীর সঙ্গে নিপীড়নমূলক আচরণ করতে দেখা যায় কয়েকজনকে। ওই নারী থানায় ধর্ষণের অভিযোগে মামলাও করেছেন। পরে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে মামলা প্রত্যাহার করবেন বলে জানিয়েছেন। এ ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ফজর আলীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেখানে আসলেই কী ঘটেছে তদন্ত করছে পুলিশ। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভুক্তভোগী নারীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। একই সঙ্গে সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন থেকে ভুক্তভোগীর ভিডিও ও ছবি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একটি রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি সৈয়দ জাহেদ মনসুরের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ গতকাল রুলসহ এ আদেশ দেন। এ ঘটনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা হবে বলে জানিয়েছেন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান এবং জাতীয় পার্টি ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে।
কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, মুরাদনগর উপজেলার বাহেরচর পাচকিত্তা গ্রামের ফজর আলীর ধর্ষণের শিকার হন বলে মামলায় অভিযোগ করেন এক নারী। ওই ঘটনার সময় সুমন নামের একজনের নেতৃত্বে ওই নারীকে বিবস্ত্রের পর মারধর ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এদিকে গতকাল ভোরে পুলিশ প্রধান অভিযুক্ত ফজর আলীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। অভিযুক্ত ফজর আলীকে (৩৮) গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকা থেকে। এ ঘটনার ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় গ্রেপ্তার চারজন হলেন- প্রতিবেশী অনিক, সুমন, রমজান ও বাবু। ভুক্তভোগী নারী জানান, তিনি বিবাহিত। দুই সন্তানের জননী। ফজর আলী নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে তার মা ৫০ হাজার টাকা ধার নেন। টাকা নিয়ে তার সঙ্গে কথা হতো। এটি মেনে নিতে পারেননি ফজর আলীর ছোট ভাই শাহ পরান। এ নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। গত ২৬ জুন রাত সাড়ে ১১টার সময় ওই নারীর বাবার বাড়িতে যান ফজর আলী। ১৫ দিন ধরে তিনি বাবার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। ফজর আলী যে সময় ভুক্তভোগীর বাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন, ওই সময়ে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বাড়ির অন্য সবাই বাইরে অবস্থান করছিলেন। সে সুযোগে ঘরে প্রবেশ করেন ফজর আলী। ঘরে প্রবেশের তিন মিনিটের মধ্যে চারজন যুবক এসে ওই নারী ও ফজর আলীকে বেদম মারধর করেন। এ সময় বিবস্ত্রের পর ভিডিওচিত্র ধারণ করা হয়। স্থানীয়দের ধারণা, ফজর আলীর পেছনে তরুণদের লাগিয়ে দেন তার ভাই শাহ পরান। ২৭ জুন ফজর আলীকে আসামি করে ধর্ষণের মামলা করেন ভুক্তভোগী নারী। এদিকে বিবস্ত্র মারধরের ভিডিওচিত্র ২৮ জুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী তীব্র সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুর রব বলেন, ফজর আলী আগে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। এখন বিএনপির পরিচয় দেন। তার কোনো পদ-পদবি নেই। মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুর রহমান বলেন, গ্রেপ্তার পাঁচজনের মধ্যে সুমন রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি। সুমনের নেতৃত্বে ওই নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং ভিডিও ধারণ করা হয়। গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। কুমিল্লার পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খাঁন জানান, ভুক্তভোগী নারীর মামলায় মূল অভিযুক্ত ফজর আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিএনপির সংবাদ সম্মেলন : এদিকে এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করে মুরাদনগর উপজেলা বিএনপি। কুমিল্লা নগরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ আত্মগোপনে চলে যায়। স্থানীয় ওসি ও একজন উপদেষ্টার বাবার পৃষ্ঠপোষকতায় তারা আবার মাঠে সক্রিয় হয়েছে।
মুরাদনগরের ধর্ষণের ঘটনা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করবে সরকার : আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আলোচিত ধর্ষণের ঘটনাটি সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করবে। গতকাল রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। আসিফ নজরুল বলেন, মুরাদনগরে যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এ ঘটনায় দেশের যে কোনো নাগরিকের মতো আমরা সবাই মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছে।
ভুক্তভোগী নারীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নির্দেশ : মুরাদনগরের ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। একই সঙ্গে সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন থেকে ভুক্তভোগীর ভিডিও ও ছবি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একটি রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি সৈয়দ জাহেদ মনসুরের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ গতকাল রুলসহ এ আদেশ দেন।
ওই ঘটনা নিয়ে ‘দরজা ভেঙে এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ, মামলা’ শিরোনামে গতকাল গণমাধ্যমে প্রতিবেদন ছাপা হয়। ওই প্রতিবেদন যুক্ত করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মীর এ কে এম নূরুন্নবী রিটটি করেন। আদালতে রিটের পক্ষে তিনি নিজেই শুনানি করেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি হিন্দুধর্মাবলম্বী এক নারীকে শ্লীলতাহানি ও নির্যাতন এক নির্মম কলঙ্কজনক ঘৃণ্য ঘটনা। এই বর্বরোচিত ঘটনা দেশের মানুষকে ব্যথিত ও মর্মাহত করেছে।
কঠোর শাস্তি চান জামায়াত আমির : মুরাদনগরে ঘরের দরজা ভেঙে প্রবাসীর স্ত্রী ধর্ষণের তোলপাড় করার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। এ ঘটনাকে লজ্জাজনক আখ্যায়িত করে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন তিনি। গতকাল নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ কথা বলেন।