দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে রয়েছে। প্রায় সব নদনদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিস্তার পানি বেড়ে বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে তলিয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
লালমনিরহাট : কয়েক দিন ধরে ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তৃতীয় দফায় লালমনিরহাট জেলার তিস্তার বাম তীরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারাজে পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। গতকাল দুপুরে বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদীপাড়ের বাসিন্দারা জানান, পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে তিস্তা নদীর বাম তীরে লালমনিরহাট জেলার নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের আবাদকৃত ফসলের খেতে পানি উঠেছে। নিম্নাঞ্চলের পরিবারগুলো পানিবন্দি হয়ে পড়ছে। যার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এরই মধ্যে চরাঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
তিস্তার পানি বৃদ্ধির ফলে লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী উপজেলার বেশ কিছু নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়েছে। এর মধ্যে পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, দোআনী, ছয়আনী, সানিয়াজান, সিঙ্গীমারী, সিন্দুর্না, হলদিবাড়ী, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জের ভোটমারী, শৈলমারী, নোহালী, আদিতমারীর মহিষখোচা, গোবর্ধন, বাহাদুরপাড়া, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, মোগলহাট, রাজপুর ও গোকুন্ডা ইউনিয়নের নিচু অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। হাতীবান্ধার ইউএনও শামীম মিঞা জানান, আমরা সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। এরই মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম : টানা বৃষ্টিতে দুই দিন ধরে কুড়িগ্রামে তিস্তা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদসহ সবকটি নদনদীর পানি আবারও হু-হু করে বাড়ছে। এ অবস্থায় নিম্নাঞ্চলসমূহ তলিয়ে গেছে। দুপুরে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ২৪ ঘণ্টায় সবকটি নদনদীর পানি দ্রুতগতিতে বাড়ছে। বিশেষ করে দুধকুমার নদের পাটেশ্বরী পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার মাত্র ২১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে ও তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং ধরলা নদীর সেতু পয়েন্টে ৭ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৮০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়াও ব্রহ্মপুত্র নদের তিনটি পয়েন্টেও পানি বাড়ছে। ফলে সব নদনদীর পানি ক্রমেই বাড়ায় নদনদীর অববাহিকার নিম্নাঞ্চলসমূহে পানি উঠেছে। এসব এলাকার নিচু ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে এবং নিম্নাঞ্চলের শাকসবজি, রোপা আমনসহ বীজতলা তলিয়ে গেছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান জানান, নতুন করে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদের পানি দ্রুতই বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, আজ রাতে তিস্তা ও দুধকুমার নদের পানি বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। উজানের ঢলের পাশাপাশি জেলায় ও উজানে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণেই দ্রুত পানি বাড়ছে।
রাজশাহী : রাজশাহীতে গত দুই দিন থেকে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। বিপৎসীমার মাত্র দশমিক ৫৭ সেন্টিমিটার নিচে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ৬ সেন্টিমিটার। গতকাল সকাল ৯টায় ১৭ দশমিক ৪৯ সেন্টিমিটার উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। রাজশাহীতে পদ্মার পানির বিপৎসীমা ১৮ দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান অঙ্কুর জানান, ঝুঁকি বিবেচনায় বাঁধগুলোতে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করা হয়েছে। ভাঙনপ্রবণ এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
রংপুর : তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় রংপুরের তিন উপজেলার তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপচরের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি বৃদ্ধির কারণে বন্যার আশঙ্কায় নদীর তীরবর্তী এলাকায় সতর্কবার্তা পৌঁছে দিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গেল কয়েক দিন ধরে উজানের পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তা নদীর পানি বাড়ছে। গতকাল দুপুর ১২টায় তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্র্রবাহিত হয়েছে। অন্যদিকে সকাল থেকে পানি বৃদ্ধি পেলেও দুপুর ১২টায় কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এতে গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, লক্ষ্মীটারী, গজঘণ্টা ও মর্ণেয়া ইউনিয়ন, কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, টেপামধুপুর ইউনিয়ন এবং পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নে তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর, দ্বীপচরের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। বন্যার আশঙ্কায় অনেকে ঘরবাড়ি নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।
কুষ্টিয়া : কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে প্রতিদিনই হু-হু করে বাড়ছে পদ্মা ও গড়াই নদীর পানি। এক সপ্তাহে পদ্মা নদীতে পানি বেড়েছে প্রায় ১৫০ সেন্টিমিটার।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, পদ্মার পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই পদ্মা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। ধারাবাহিক পানি বৃদ্ধির ফলে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে নদীর পার্শ্ববর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমির ফসলের খেত। চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর এ দুই ইউনিয়ন মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইউনিয়ন দুটিতে অবস্থিত ১৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, ভারত থেকে ফারাক্কা হয়ে পানি পদ্মায় পড়ছে। গত ২ আগস্ট থেকে ধারাবাহিকভাবে পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। প্রতিদিন গড়ে ১২ থেকে ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মঙ্গলবার সরেজমিন দেখা গেছে, পদ্মা নদীতে হু-হু করে পানি বাড়ছে। দুই দিন আগেও যেসব এলাকা শুকনা ছিল, এখন সেখানে বন্যার পানিতে থই থই করছে। যেদিকে চোখ পড়ে শুধু পানি আর পানি। চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ইউনিয়ন দুটি মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ : নদী ভাঙনের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এরই মধ্যে বন্যার পানির নিচে ৮ হাজার ৩০০ কৃষকের আমন ধান, ভুট্টাসহ ২ হাজার হেক্টর জমির ফসল। একদিকে ভাঙন অন্যদিকে বন্যা নিয়ে শঙ্কায় দিন পার করছেন নদীতীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারী প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পদ্মায় পানি বৃদ্ধি পেলেও জেলায় বন্যার আশঙ্কা নেই। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, বুধবার সকাল ৯টায় শিবগঞ্জে পদ্মা নদীর পাঙ্খা পয়েন্টে পানির সমতল ছিল ২১ দশমিক ৭১ মিটার এবং ৬ ঘণ্টা পর বেলা ৩টায় ১ সে.মিটার বেড়ে পানির সমতল হয় ২১ দশমিক ৭২ মিটার। এদিকে ৫-৬ দিন ধরে পানি বৃদ্ধির ফলে পদ্মাপাড়ের মানুষের মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৭ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় অন্তত ১৫টি পয়েন্টে ধসে পড়েছে মেঘনা নদীর তীররক্ষা বাঁধ। জোয়ারের চাপে বাঁধের বেশ কিছু অংশ দেবে গেছে আর ব্লক সরে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় গর্ত। এমন পরিস্থিতিতে বিপদাপন্ন অবস্থায় রয়েছে হাজারো মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভাঙন রোধে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রামগতির বড়খেরী ইউনিয়নের মাছঘাটসংলগ্ন এলাকায় মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ে নদীর তীররক্ষা বাঁধে ধস দেখা দিয়েছে। অন্তত ১২ থেকে ১৫টি স্থানে ব্লকের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়ে সেগুলো দেবে গেছে। আর কমলনগরের মাতাব্বরহাট ও লুধুয়ায় আরও ২টি পয়েন্টে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ভাঙন। স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক দিন ধরেই জোয়ারের পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তীব্র স্রোত ও ঢেউ। ফলে পুরোনো বাঁধের নিচের মাটি সরে গিয়ে ব্লকগুলো বসে গেছে। এতে আশপাশের লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।