ঈদের ছুটিতে রাজনৈতিক অঙ্গন ও সারা দেশে সাধারণ মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন আগামী শুক্রবার লন্ডনে অনুষ্ঠেয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক। সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ ও সম্ভাব্য রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলমান আলোচনা ও বিরাজমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে দেশের দুই শীর্ষনেতার এ বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে আগামী এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর সঙ্গে সরকারের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেই কারণে সরকারপ্রধানের সঙ্গে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির শীর্ষনেতা তারেক রহমানের বৈঠক আয়োজন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছিল না। সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ এবং দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে সরকারের তরফে বারবার যোগাযোগের পর শেষ পর্যন্ত সোমবার রাতে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি এ বৈঠকে রাজি হয়েছে। শুক্রবার লন্ডন সময় সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে সেন্ট্রাল লন্ডনে হাইড পার্কের কাছে ডরচেষ্টার হোটেলে দুই শীর্ষনেতার ওয়ান-টু-ওয়ান এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। চার দিনের যুক্তরাজ্য সফরে প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যে লন্ডন পৌঁছে এ হোটেলে অবস্থান করছেন।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লসের কাছ থেকে হারমোনি অ্যাওয়ার্ড নিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের লন্ডন সফরের ঘোষণার পর থেকেই তাঁর সঙ্গে লন্ডনে নির্বাসিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক আয়োজনের আলোচনা শুরু হয়। গত বছরের ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাঁর এখনো সাক্ষাৎ হয়নি। তাই প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম যুক্তরাজ্য সফরে দুই নেতার দেখা-সাক্ষাতের সম্ভাবনা নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে জল্পনকল্পনা শুরু হয়। সরকারের তরফে বিএনপি মহাসচিবসহ দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে প্রাথমিক যোগাযোগের পর প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে তারেক রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে সৌজন্য সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানানো হয়। সফরের শেষ দিনে ১৩ জুন শুক্রবার সকালে বৈঠকের সময় নির্ধারণ করে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উভয় চ্যানেলে বিএনপির শীর্ষনেতার কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়। বিএনপিসূত্র বলছে, মূলত প্রধান উপদেষ্টার ব্যক্তিগত আগ্রহ এবং সরকারের সিনিয়র উপদেষ্টাদের জোর চেষ্টার কারণে শেষ পর্যন্ত এ বৈঠক আয়োজনের উদ্যোগ সফল হতে যাচ্ছে।
ওয়াকিবহাল সূত্র জানায়, নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে বিএনপি শুরু থেকেই এ বৈঠকে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে আসছিল। তবু সরকারের কয়েকজন সিনিয়র ও প্রভাবশালী উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠকটি আয়োজনের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এ নিয়ে ঢাকা ও লন্ডনে কূটনৈতিক তৎপরতাও চলতে থাকে। আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান ইস্যুগুলো সমাধানের বিভিন্ন সম্ভাবনা তুলে ধরে বৈঠকে রাজি করাতে চেষ্টা চালানো হয়। বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয় যে এ বৈঠক একটি সুন্দর সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে শুভেচ্ছাবিনিময় ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা আগামী নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার নিয়ে তাঁর সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরতে পারবেন, সরাসরি তারেক রহমানের মুখে শুনতে পারবেন এসব বিষয়ে তাঁর মতামত ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।
এ যোগাযোগের একপর্যায়ে ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এ ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে ডিসেম্বরে নির্বাচনের জোরালো দাবি জানায়। তারা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে রোজা ও মার্চে ঈদের ছুটি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা, কালবৈশাখি ও ঝড়বৃষ্টির মৌসুমে নির্বাচনি কার্যক্রম ও প্রচারণা চালানোর অসুবিধার যুক্তি তুলে ধরে চলতি বছরের শেষে নির্বাচনের দাবি অব্যাহত রাখে। সূত্রমতে এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির অসন্তোষের কারণে লন্ডনে দুই নেতার শীর্ষ বৈঠক আয়োজনে নতুন করে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এর মধ্যে সরকার বিএনপির অপছন্দের একজন উপদেষ্টা মর্যাদার কর্মকর্তাকে লন্ডন বৈঠক আয়োজনে মধ্যস্থতার দায়িত্ব দেওয়ায় দলটি এ আলোচনা থেকে পিছিয়ে যায়। দলীয় সূত্রমতে, ইতোপূর্বে বিএনপি সরকারের আরেকজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি জানানোর পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপি প্রতিনিধিদলের বৈঠকে সরকার পক্ষে ওই উপদেষ্টা উপস্থিত থাকায় দলটি অসন্তোষ প্রকাশ করে। ওই জটিল পরিস্থিতিতে কয়েকজন সিনিয়র উপদেষ্টা এগিয়ে আসেন এবং দ্রুত ব্যাংককে চিকিৎসাধীন বিএনপি মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বৈঠকটি আয়োজনের অনুরোধ করেন। তাঁরা চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ বৈঠকের গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং আলোচনার সম্ভাব্য বিষয়ের ওপর জোর দেন।
ঈদের ছুটির মধ্যেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাসহ কূটনৈতিক মহলে এ বৈঠক আয়োজন নিয়ে নতুন করে চেষ্টা শুরু হয়। গত রবি ও সোমবার সম্ভাব্য বৈঠকের খবর বের হলেও সোমবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রার আগপর্যন্ত বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে এ বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের যোগদানের ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করেনি। স্থায়ী কমিটির সূত্রে জানা যায়, স্থায়ী কমিটির সভায় তারেক রহমান লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ পাওয়ার বিষয় জানিয়ে এ ব্যাপারে দলের নীতিনির্ধারকদের মতামত জানতে চান। বিস্তারিত আলোচনার পর নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা ও আরও কয়েকটি স্পর্শকাতর ইস্যু সরকারপ্রধানের সঙ্গে সরাসরি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আশায় কৌশলগত কারণে কমিটি দলের শীর্ষ নেতাকে এ বৈঠকে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানায়। স্থায়ী কমিটি একই সঙ্গে তারেক রহমানকে শুক্রবারের প্রস্তাবিত বৈঠকে দলের পক্ষে যে কোনো বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আশা প্রকাশ করেছেন যে এ শীর্ষ বৈঠক রাজনীতিতে নতুন ডাইমেনশন তৈরি করতে পারে। বর্তমান সরকারপ্রধানের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সরকারের সম্ভাব্য প্রধানের বৈঠকটিকে তিনি সমকালীন রাজনীতির সবচেয়ে বড় ইভেন্ট বলে অভিহিত করে আশা প্রকাশ করেছেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধানের পথ তৈরি হবে। তাঁর ভাষায়, এ বৈঠক হতে পারে রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট।