‘আকাশেতে লক্ষ তারা চাঁদ কিন্তু একটা রে...’। হ্যাঁ ওই চাঁদটিই আমাদের চলচ্চিত্রের চ্যালেঞ্জিং হিরোইন ‘পপি’। যাঁর অনিন্দ্য সুন্দর দেহবল্লরীর জন্য চিত্রজগতে তাঁকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল ‘বুনোসুন্দরী’ হিসেবে। এই সুন্দরীর অভিনয় প্রেমে মাতোয়ারা ছিলেন আবালবৃদ্ধবনিতা, মানে সব বয়সি, সব শ্রেণির দর্শকরা। কিন্তু দর্শকদের পোড়া কপাল, দীর্ঘদিন তাঁরা বঞ্চিত রয়েছেন পপির সুশ্রী মুখশ্রী দর্শনে।
কেন পপি পর্দায় নেই, বাস্তবেও তাঁর দেখা মেলা ভার। আর এটিই এখন পপি ভক্তদের মনোবেদনা। তারপরও আকাশ-পাতাল প্রত্যাশা সবার। পপিকে একনজর দেখে প্রাণ জুড়াবার অপেক্ষায় রয়েছেন তাঁরা। কিন্তু পপি কী আসলেই ফিরবেন?
মনে হয় না। কারণ পপির ঘনিষ্ঠ মহল বলছেন, বড়পর্দায় পপির ফেরার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ ঘর-সংসার স্বামী-সন্তান নিয়ে মহাব্যস্ত এখন তিনি। একমাত্র ছেলেকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতেই নিজের যত শ্রম নিবেদন করছেন তার পেছনে।
ঘনিষ্ঠ সূত্রটি বলছে, পপির কথা হলো- ‘অভিনয় তো অনেক করলাম, আর অভিনয় করতে গিয়ে নিজেকে সময় দেওয়ার ফুরসতটুকুই পাইনি। কমপক্ষে দুই দশকেরও বেশি সময় দিনে-রাতে, রোদে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে শুধু কাজ আর কাজ করেছি। যখন বড় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম, তখনই নিজের ভিতর থেকে অবসরের ডাক পেলাম। ব্যস, আমি এখন সংসার ধর্মের বাসিন্দা। এটিই এখন আমার একমাত্র ঠিকানা। আগামীতে কী হবে- কে বলতে পারে? তাই আমিও এমন কোনো আশ্বাস দিতে চাই না, যেটি আমিই জানি না।’ পপির এমন কথায় তাহলে অনেকটা নিশ্চিত বলা যায়, সিনেমার ঝলমলে আলো আর অ্যাকশন কাটে বুনোসুন্দরী পপির আলোকরশ্মি হয়তো আর দেখা যাবে না।
আসলে অভিনয়ে পপি ছিলেন নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। এক্সপেরিমেন্টাল কিংবা কমার্শিয়াল- দুই ধরনের চলচ্চিত্রেই সমান অভিনয় ক্যারিশমা দেখিয়েছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ টানা যায়, ‘কারাগার’ ও ‘মেঘের কোলে রোদ’- দুটি চলচ্চিত্রই ভিন্ন ঘরানার। দুটোতেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সম্মান বহন করে এনেছেন সুশ্রী পপি। এগুলো ছাড়া অফ ট্র্যাক চলচ্চিত্র ‘গঙ্গাযাত্রা’তেও অভিনয় জাত চিনিয়ে জাতীয় পুরস্কার নিজের ঝুলিতে পুরে নিয়েছেন এই সুন্দরী অভিনেত্রী। এ ধরনের টাফ জব পপির আরও আছে। বিদ্রোহী পদ্মা, রাণী কুঠির বাকি ইতিহাস, কি জাদু করিলা, দরিয়া পাড়ের দৌলতী, ওপারে আকাশ প্রভৃতি। অসাধারণ এসব ছবি। পপি প্রতিটি ছবির জন্য বারবার নিজেকে ভেঙেছেন আর গড়েছেন। ‘গঙ্গাযাত্রা’য় পপির কস্টিউম, গেটআপ দেখলেই বোঝা যায় বাংলার নারী এভাবেই রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা হয়। ‘রাণী কুঠির বাকি ইতিহাস’ টাফ ছিল। ভারী ক্যারেক্টার। নিজের মায়ের হত্যাকারীকে খুঁজতে রাণী কুঠিটি তাঁকে অলৌকিকভাবে সাহায্য করে। মায়ের লাশ সিঁড়ির ধারে দেখে হত্যাকারী আলমগীরের অস্পষ্ট চেহারাটা শেষে স্পষ্ট হয়। পপিকে এই চলচ্চিত্রে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজটা করতে হয়েছে লিজেন্ড আলমগীরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, দেখিয়েছেন দাপুটে অভিনয়। ‘কি জাদু করিলা’ তাঁর অভিনয় সমৃদ্ধ আরেকটি চলচ্চিত্র। এখানেই রীতিমতো গল্পের আলোতে নিজের সুঅভিনয় ঝলকানি দেখিয়ে ছেড়েছেন অনিন্দ্য সুন্দরী পপি। পপির ক্যারিয়ারে কমার্শিয়াল সিনেমার সংখ্যাই বেশি। সেগুলোতে ক্যারেক্টারের ভ্যারিয়েশন আছে। তবে তাঁকে বদমেজাজি, অহংকারী ক্যারেক্টারগুলোতে অনবদ্য লাগে। কমার্শিয়াল ছবিতে গুড লুকিং, গ্ল্যামার, গুড ভয়েস, গুড অ্যাকটিং এসবের যে সমাবেশ দরকার তার সবকটিই পপির মধ্যে আছে।
‘আমার ঘর আমার বেহেস্ত’ ছবিতে পপির প্রথম অভিনয় ছিল অসাধারণ। তাঁর এক্সপ্রেশনে তখনই পেশাদারির ভাব চলে এসেছিল। স্ট্রং দিক হিসেবে সেটাই তাঁকে পরের দিনগুলোতে এগিয়ে নিয়েছিল। পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শাকিল খানের সঙ্গে জুটির তকমাটা তখনই জোরেশোরে দানা বাঁধে। ‘ভালোবাসার ঘর’ ছবির পপি গ্ল্যামারাসে অনেক এগিয়ে। অমিত হাসানের সঙ্গে জুটিটা দেখার মতোই ছিল। তাঁদের প্রেমের সময়গুলো ছবির সেরা মুহূর্ত। ‘তোমার জন্য ভালোবাসা’ পপির সঙ্গে আমিন খানের সেরা ছবি। ‘কুলি’ তো একাই এক শ’। ওমর সানীর সঙ্গে পপি প্রথম ছবিতেই সাফল্যের পরিচয় দেন। ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে ‘মনের মিলন’ ছবিটি গ্রামের গল্পকে বড় আকারে উপস্থাপন করেছে। রিয়াজের সঙ্গে ‘ক্ষ্যাপা বাসু, মেঘের কোলে রোদ’- এ চলচ্চিত্র দুটোতে দুই রকম গল্পের জন্য তফাতটা যেমন ধরা যায়, তার সঙ্গে সহজে বেছে নেওয়া যায় কোনটা কত গুরুত্বপূর্ণ। মান্নার সঙ্গে অ্যাকশন ছবিগুলোতে পপির উপস্থিতি ভিন্ন। সেখানে তাঁকে গল্পের প্রয়োজনে কখনো অসহায় দেখা গেছে, আবার কখনো অগ্নিশর্মা হতে হয়েছে। রুবেলের ছবিতেও তাই। অন্যদিকে ছোটপর্দার নাটকে রিয়াজের সঙ্গে মেম সাহেব, তবুও তুমি আমার, নায়িকার বিয়ে, এ কাজগুলো মনে রাখার মতো। তবু বলতে হয়, চলচ্চিত্রের পপিই সবচেয়ে ডিফারেন্ট। কেননা এটাই তাঁর আসল প্ল্যাটফর্ম। কমার্শিয়াল ও এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমায় তাঁর আলাদা পারফেকশন আছে। ক্যারেক্টার লিড দিতে সর্বোচ্চ পরিশ্রম করে। পাল্টে ফেলতে পারে নিজেকে। আমরা কুলি, মনের মিলন, ভালোবাসার ঘর- এ ছবিগুলোর সঙ্গে ‘কারাগার’ বা ‘মেঘের কোলে রোদ’কে কোনোভাবেই এক পাল্লায় আনতে পারব না। অথচ এগুলোও কমার্শিয়াল ছবি। কিন্তু প্রেজেন্টেশনে পরিবার, বাস্তবতা, প্রতিশোধ, প্রেম, পরনির্ভরশীল থাকার কষ্ট, প্রতিবাদ, নারীবাদী প্রয়োগ- এসব এই সিনেমা স্রোতের বিপরীতের কমার্শিয়াল কাজ। এক্সপেরিমেন্টালে এলে, ‘রাণী কুঠির বাকি ইতিহাস, বিদ্রোহী পদ্মা, গঙ্গাযাত্রা, কি জাদু করিলা’ এই ছবিগুলোতে পপি নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। আর এসবই একজন অভিনেত্রীকে পূর্ণাঙ্গভাবে সাফল্য এনে দেয়। যা পপির পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। খুলনার মেয়ে সাদিকা পারভীন পপির শোবিজ জগতের উঠোনে পা রাখা ১৯৯৫ সালে ‘লাক্স আনন্দ বিচিত্রা সুন্দরী’ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাধ্যমে। আর চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে ১৯৯৭ সালে। প্রথম ছবি (শুটিং সূত্রে) ‘আমার ঘর আমার বেহেশত’ ও মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি ‘কুলি’র মাধ্যমে। ‘আকাশেতে লক্ষ তারা চাঁদ কিন্তু একটা রে...’ কুলিতে পপির লিপে গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, যার কারণে এখনো আমাদের চলচ্চিত্র জগতের আকাশে ‘চাঁদ শুধু একটা রে’ হয়ে আছেন বুনোসুন্দরী পপি।