প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে ঢাকায় বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। জীবনঘনিষ্ঠ কাহিনি ও দক্ষ নির্মাণশৈলীর কারণে এসব চলচ্চিত্র দর্শকমন জয়ের পাশাপাশি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও লাভ করে। ঢাকায় বিভিন্ন উপন্যাস নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘বসুন্ধরা’
বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম আলাউদ্দিন আল আজাদ। বাংলা সাহিত্যে শানিত ভাষার এই লেখকের ‘তেইশ নম্বর তৈলচ্চিত্র’ তার রচিত প্রথম উপন্যাস। ১৯৬০ সালে একটি পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় উপন্যাসটি প্রথম ছাপা হয়। ১৯৭৭ সালে এ উপন্যাসটি নিয়ে প্রথিতযশা চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র ‘বসুন্ধরা’। ববিতা ও ইলিয়াস কাঞ্চন অভিনীত এ ছবিটি গল্পের মুন্শিয়ানা ও নির্মাণশৈলীর কারণে শ্রেষ্ঠ ছবিসহ নানান শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।
জহির রায়হানের উপন্যাস নিয়ে
‘হাজার বছর ধরে’ প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান রচিত এক সামাজিক উপন্যাস। ২০০৫ সালে এ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রকার সুচন্দা নির্মাণ করেন ‘হাজার বছর ধরে’ সিনেমাটি। এটি আটটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। তা ছাড়া জহির রায়হান তাঁর জীবদ্দশায় নিজের উপন্যাস নিয়ে নিজেই নির্মাণ করেন ‘আনোয়ারা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’সহ বেশ কটি চলচ্চিত্র। এসব ছবি নানা শাখায় পুরস্কারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।
রাবেয়া খাতুনের ‘মেঘের পর মেঘ’, ‘মধুমতি’
ঔপন্যাসিক রাবেয়া খাতুনের ‘মেঘের পরে মেঘ’ উপন্যাসটি নিয়ে ২০০৪ সালে একই শিরোনামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। এটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গল্পের চলচ্চিত্র। ২০১১ সালে শাহজাহান চৌধুরী নির্মাণ করেন রাবেয়া খাতুনের ‘মধুমতি’ উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র ‘মধুমতি’। এটি তাঁতিদের এই পেশা নিয়ে জীবন-যন্ত্রণার একটি চিত্র। দুটি সিনেমাই পুরস্কারসহ দর্শকনন্দিত হয়।
সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ও পোকামাকড়ের ঘরবসতি’
প্রখ্যাত উপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম ১৯৯৭ সালে নির্মাণ করেন ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ এবং ১৯৯৬ সালে অভিনেত্রী ববিতার প্রযোজনায় আখতারুজ্জামান নির্মাণ করেন ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ সিনেমা দুটি। ছবি দুটি সেরাসহ নানা শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’
প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ উপন্যাস অবলম্বনে তানভীর মোকাম্মেল পরিচালনায় ২০০১ সালে ‘লালসালু’ শিরোনামেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। রাইসুল ইসলাম আসাদের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন এবং ছবিটি বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার জিতে নেয়।
হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় আট চলচ্চিত্র
কলমের জাদুকর খ্যাত প্রখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদ নিজের উপন্যাস নিয়ে নিজেই আটটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এগুলো হলো- ‘আগুনের পরশমণি’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘নয় নাম্বার বিপদ সংকেত’, ‘আমার আছে জল’ ও ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ এসব চলচ্চিত্র বিভিন্ন শাখায় বহু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস নিয়ে যত চলচ্চিত্র
হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস থেকে নির্মিত হয়েছে বহু কালজয়ী সিনেমা। তাঁর উপন্যাস থেকে নির্মিত সিনেমাগুলো হলো- শঙ্খনীল কারাগার, এটি পরিচালনা করেন মুস্তাফিজুর রহমান, মুক্তি পায় ১৯৯২ সালে। তাঁর ‘কৃষ্ণপক্ষ’ উপন্যাস নিয়ে একই নামে ছবি নির্মাণ করেন মেহের আফরোজ শাওন। ২০১৬ সালে এটি মুক্তি পায়। ২০১৮ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা ‘দেবী’। এটি পরিচালনা করেন অ ন ম বিশ্বাস। ২০১৮ সালের সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা ছিল ‘দেবী’। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস নিয়ে সুভাষ দত্ত নির্মাণ করেন ‘আবদার’। তাঁর উপন্যাস থেকে মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘দূরত্ব’ ও ‘প্রিয়তমেষু’। ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘নন্দিত নরকে’ সিনেমা পরিচালনা করেন বেলাল আহমেদ। ‘সাজঘর’ উপন্যাস থেকে শাহ আলম কিরণ তৈরি করেন ‘সাজঘর’, ‘জনম জনম’ উপন্যাস অবলম্বনে আবু সাইয়ীদ নির্মাণ করেন ‘নিরন্তর’ এবং অভিনেতা তৌকীর আহমেদ নির্মাণ করেন সিনেমা ‘দারুচিনি দ্বীপ’। প্রতিটি সিনেমাই গল্প ও নির্মাণে মানের জন্য সেরাসহ একাধিক জাতীয় পুরস্কার লাভ করে।
জাফর ইকবালের ‘দীপু নাম্বার টু’ ও ‘আমার বন্ধু রাশেদ’
মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস ‘দীপু নাম্বার টু’ অবলম্বনে ১৯৯৬ সালে মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেন একই শিরোনামের একটি চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি রাষ্ট্রীয় অনুদানে নির্মিত হয়। অন্যদিকে ২০১১ সালে জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয় সিনেমা? ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ এটি নির্মাণ করেন বরেণ্য চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম। জাতীয় পুরস্কারে সেরা ছবিসহ নানা শাখায় পুরস্কৃত হয় এই ছবিটি।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’
১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটক নির্মাণ করেন কালজয়ী সিনেমা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম অবলম্বনে এ সিনেমাটি নির্মাণ করেন তিনি। এতে অভিনয় করেন প্রবীর মিত্র, রোজী সামাদ, কবরী ও গোলাম মুস্তাফা প্রমুখ।
তারাশঙ্করের ‘চাঁপা ডাঙার বউ’
১৯৮৬ সালের ৬ জুন মুক্তি পায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ‘চাঁপা ডাঙার বউ’ চলচ্চিত্রটি। নায়করাজ রাজ্জাকের পরিচালনায় ছবিটিতে অভিষেক ঘটে তাঁর পুত্র বাপ্পারাজের। মূল চরিত্রে শাবানা, এ টি এম শামসুজ্জামানের সঙ্গে ছিলেন নবাগতা অরুণা বিশ্বাস। সিনেমাটি সেই সময় বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’, ‘শুভদা’
চাষী নজরুল ইসলাম শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘দেবদাস’ অবলম্বনে একই নামে ১৯৮২ সালে প্রথমবার ও ২০১৩ সালে দ্বিতীয়বার দেবদাস নির্মাণ করেন। এ ছাড়া ১৯৮৬ সালে শরৎ সাহিত্য থেকে চাষী নির্মাণ করেন ‘শুভদা’ চলচ্চিত্রটি। এটি ১৩টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়, যেটি ছিল বিরল এক রেকর্ড।
রবীন্দ্র উপন্যাসের চলচ্চিত্র
অবুঝ বউ, রবীন্দ্রনাথের ‘সমাপ্তি’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটি পরিচালনা করেন নারগিস আখতার। চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন রবীন্দ্রনাথের ‘সুভাষিণী’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র ‘সুভা’। রবীন্দ্রনাথের ‘শাস্তি’ উপন্যাস অবলম্বনে ২০০৪ সালে ‘শাস্তি’ সিনেমাটি নির্মাণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন কাজী হায়াৎ। এতে অভিনয় করেন মান্না ও দিঘী। প্রতিটি ছবিই নানা শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।
নজরুল উপন্যাসের চলচ্চিত্র
খান আতাউর রহমান নজরুল সাহিত্য নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ১৯৭১ সালে। নজরুলের ‘পদ্মগোখরা’ গল্প থেকে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটির নাম ‘সুখ-দুঃখ’। নির্মাতা মুস্তাফিজ ১৯৭৬ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘মায়ার বাঁধন’, এটিও নজরুলের ‘পদ্মগোখরা’ গল্প থেকে নেওয়া। নব্বই দশকে নজরুলের ‘জ্বীনের বাদশা’ গল্প থেকে একই নামের চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন প্রয়াত নায়করাজ রাজ্জাক। ২০০৪ সালে নজরুলের ‘রাক্ষুসী’ উপন্যাস নিয়ে একই নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন মতিন রহমান। ২০০৫ সালে নজরুলের ‘মেহের নেগার’ থেকে একই নামের চলচ্চিত্রটি যৌথভাবে পরিচালনা করেন মুশফিকুর রহমান গুলজার ও মৌসুমী। নির্মাতা গীতালি হাসান নজরুলের ‘অতৃপ্ত কামনা’ থেকে ২০১৪ সালে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র ‘প্রিয়া তুমি সুখী হও’। ছবিগুলো জাতীয় পুরস্কার লাভসহ প্রশংসিত হয়।