বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি ও সরকারের সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধের জেরে তুমুল বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি। টানা দুই দিনের বিক্ষোভের মুখে গতকাল প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী অলির পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পৌদেলও পদত্যাগ করেছেন বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। তবে প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে তা নিশ্চিত করা হয়নি। বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানায়, প্রধানমন্ত্রী অলি পদত্যাগ করেছেন বলে তাঁর সচিবালয় এক বিবৃতিতে নিশ্চিত করেছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, পদত্যাগের পর এখন দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন অলি। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সহায়তা চেয়েছেন প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ। চিকিৎসার কথা বলে তিনি দুবাইয়ে চলে যেতে পারেন। তাঁর জন্য হিমালয়া এয়ারলাইনসের একটি বিমানও প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। এদিকে, প্রধানমন্ত্রী অলি পদত্যাগ করলেও গতকাল অনেক গোষ্ঠী আরোপিত কারফিউ উপেক্ষা করে বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করে এবং অগ্নিসংযোগ ও হামলার ঘটনা ঘটায়। কাঠমান্ডু পুলিশের মুখপাত্র শেখর খানালের বরাতে এএফপি এ তথ্য জানায়। ওই কর্মকর্তা এএফপিকে জানান, গতকাল অনেক গোষ্ঠী কারফিউ উপেক্ষা করেছে।
গতকাল দেশটির পার্লামেন্ট ভবন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কার্যালয়, মন্ত্রী ও আমলাদের সরকারি বাসভবনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানী কাঠমান্ডুর দাল্লু এলাকায় গতকাল দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঝলানাথ খনালের স্ত্রী রাজ্যলক্ষ্মী ছবিকার নিহত হয়েছেন। আন্দোলনকারীরা তার বাড়ি ঘেরাও করে অগ্নিসংযোগ করলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। পারিবারিক সূত্র জানায়, দগ্ধ অবস্থায় তাকে দ্রুত কির্তিপুর বার্ন হাসপাতালে নেওয়া হলেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়। এ ছাড়া দেশটির সিভিল সার্ভিস হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক মোহন রেগমি বিবিসিকে জানান, গতকালের বিক্ষোভে আরও অন্তত দুজন নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে গত দুই দিনে দুর্নীতিবিরোধী এ গণবিক্ষোভে অন্তত ২২ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন আরও কয়েক শ। দেশজুড়ে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন নেপালের সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেল। সেনাপ্রধানসহ দেশটির অন্য সরকারি কর্মকর্তারা গতকাল একটি বিবৃতি দিয়েছেন। এতে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে; তাই আমরা সব নাগরিককে শান্ত থাকা এবং আরও প্রাণহানি ও সম্পদের ধ্বংস এড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা সব পক্ষকে রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে একটি দ্রুত ও শান্তিপূর্ণ পথ বেছে নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’ অপরদিকে, প্রধানমন্ত্রী অলির পদত্যাগের পর নতুন প্রধানমন্ত্রীর খোঁজ চলছে। এর মধ্যে রাজধানী কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দিতে দাবি জানাচ্ছে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া জেন-জি প্রজন্ম। গতকাল অলির দায়িত্ব ছাড়ার পর অনলাইনে জেন-জি বিক্ষোভকারীরা বালেন্দ্রকে দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করছেন। বালেন্দ্র শাহ আগে একজন রেপার ছিলেন।
চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ভাঙনের মুখে পড়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট সরকার। দেশটির সংসদের ২৭৫ আসনের মধ্যে ৮৯ আসনের দখল রয়েছে ক্ষমতাসীন নেপালি কংগ্রেস পার্টির। দলটির জ্যেষ্ঠ নেতা শেখর কৈরালা তাঁর সমর্থকদের সরকার থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। মাওবাদী সেন্টারের নিয়ন্ত্রণে ৩২টি আসন রয়েছে। তারাও জোট সরকার থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এ ছাড়া জনতা সমাজবাদী পার্টিসহ অন্যান্য কয়েকটি ছোট দলও সরকার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সংসদে এসব দলের প্রায় ১০টি আসন রয়েছে। পাশাপাশি ন্যাশনাল ইনডিপেন্ডেন্ট পার্টির (এনআইএসপি) ২১ জন এমপি একসঙ্গে পদত্যাগ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এই দলটি বিক্ষোভের কট্টর সমর্থক এবং সংসদ ভেঙে দিয়ে দেশে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। এতে জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ১৩৮ আসনের নিচে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিরোধী দলগুলো এখন অস্থায়ী সরকার গঠন এবং আগাম নির্বাচনের দাবি তুলছে। সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতা নেওয়া থেকে বিরত রয়েছে।
এর আগে সোমবার সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও দুর্নীতির প্রতিবাদে নেপালে বিক্ষোভ শুরু হয়। এদিন রাজধানী কাঠমান্ডু ছাড়াও ছাত্র-জনতা পোখারা, বুতোয়াল, ভারতপুর ও ইতাহারিসহ কয়েকটি শহরের রাস্তায় নামে। এদিন সকালে কাঠমান্ডুর বানেশ্বর এলাকায় প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে তা রাজধানীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিশাল বিক্ষোভের দ্বিতীয় দিন গতকাল কারফিউ উপেক্ষা করে রাজধানী কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন স্থানে সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে সেনাপ্রধানের আহ্বানে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন অলি।
প্রধানমন্ত্রী অলি পদত্যাগ করেছেন এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গতকাল দেশটির পার্লামেন্টের ভিতরে প্রবেশ করেন শত শত বিক্ষোভকারী। এ সময় পার্লামেন্টের মূল ভবনে আগুন ধরিয়ে দেন তারা। পার্লামেন্ট সচিবালয়ের মুখপাত্র ইকরাম গিরি পার্লামেন্টে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘শত শত মানুষ পার্লামেন্ট এরিয়ায় ঢুকে পড়েছেন এবং তারা মূল ভবনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন।’ শুধু পার্লামেন্ট নয়, বিক্ষুব্ধরা দেশটির প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাউডেল ও প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির ব্যক্তিগত বাসভবনে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। স্থানীয় হিমালয়ান টাইমস এক প্রতিবেদনে জানায়, কাঠমান্ডুর বোহারতার এলাকায় গতকাল নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাউডেলের ব্যক্তিগত বাসভবনে হামলা চালায় বিক্ষোভকারীরা। এ সময় তারা বাসায় ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার কাঠমান্ডুর বোটানিলকণ্ঠের বাড়িতেও ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। এ সময় শের বাহাদুর ও তার স্ত্রী আরজু রানা দেউবাকে মারধর করেন কিছু বিক্ষোভকারী। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেউবার বাড়িতে প্রবেশ করেন বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। তারা তাকে ও তার স্ত্রীকে মারধর করেন। এ ছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্জু রানা দেউবাকেও আটকে রেখেছেন তারা। আরেক সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্ট বলছে, একই দিন সকালে ভক্তপুরের বালকোটে প্রধানমন্ত্রী অলির ব্যক্তিগত বাসভবনেও আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধরা। কর্মকর্তারা জানান, ভোরে বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারী তার বাসভবনের দিকে অগ্রসর হয়। পুলিশ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তারা পিছিয়ে যায়নি এবং শেষ পর্যন্ত ভিতরের দুটি বাড়িতেই আগুন ধরিয়ে দেয়। ক্ষমতাসীন নেপালি কংগ্রেস দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও গতকাল আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। এ ছাড়া নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (টিআইএ) গতকাল নিরাপত্তা শঙ্কা ও বিরূপ পরিস্থিতির কারণে সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। এ অবস্থায় যাত্রীদের অসুবিধার জন্য ক্ষমা চেয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
বিমানবন্দরের জেনারেল ম্যানেজার হানসা রাজ পাণ্ডে জানান, নিরাপত্তার কারণে বুদ্ধ এয়ারসহ সব দেশীয় এয়ারলাইনসও তাদের সব ফ্লাইট স্থগিত করেছে।
নেপালের অর্থমন্ত্রীকে ধাওয়া দিয়ে ফেলে কিল-ঘুসি-লাথি : পদত্যাগকৃত প্রধানমন্ত্রী অলির সরকারের অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু প্রসাদ পাউডেলকে কাঠমান্ডুর রাস্তায় ধাওয়া দিয়ে ফেলে কিল-ঘুসি ও লাথি দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। এ হামলার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, দেশটির ৬৫ বছর বয়সি অর্থমন্ত্রী পাউডেল কাঠমান্ডুর রাস্তায় দৌড়াচ্ছেন এবং পেছনে শতাধিক বিক্ষোভকারী তাকে ধাওয়া করছে। হঠাৎ এক তরুণ বিক্ষোভকারী বিপরীত দিক থেকে এসে লাফিয়ে পাউডেলকে লাথি মারেন। তিনি ভারসাম্য হারিয়ে লাল দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যান। ভিডিওতে দেখা যায়, মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর অর্থমন্ত্রী দ্রুত উঠে আবার দৌড়াতে শুরু করেন। সূত্র : বিবিসি, কাঠমান্ডু পোস্ট, এনডিটিভি, এএফপি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।