১৯৭১ সালের উত্তাল সময়। ৩০ বছরের টগবগে যুবক আলমগীর কবির চলে গেলেন কলকাতায়। প্রবল ইচ্ছা- রণাঙ্গনের যুদ্ধেই যোগ দেবেন, কিন্তু হলো না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে জায়গা হলো তাঁর। ইংরেজি সংবাদ পাঠক হিসেবে যোগ দিয়ে আহমেদ চৌধুরী ছদ্মনামে খবর পাঠ শুরু করলেন। জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ সিনেমাতে কবিরের ইংরেজি ধারাভাষ্য বাঙালির ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। ‘দিস ইজ রেডিও বাংলাদেশ’, রেডিও থেকে খাঁটি ব্রিটিশ উচ্চারণে ভেসে আসা ওই ভরাট কণ্ঠস্বর সবাইকে যেন জাগ্রত করে। বন্ধু জহির রায়হান তাঁর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণকালে কবিরকে টেনে নিলেন। তাঁদের হাত দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনই নির্মিত হয়- বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের চারটি অনবদ্য দলিল ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘লিবারেশন ফাইটার্স’, ‘স্টেট ইজ বর্ন’ আর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স’। ১৯৭২-এ হারিয়ে গেলেন জহির রায়হান। প্রিয় বন্ধুর এই অন্তর্ধান নিশ্চিতভাবেই শোকাহত করেছিল কবিরকে। কিন্তু থামলেন না তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে উদ্যমে যাত্রা করলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে। একে একে নির্মাণ করলেন ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘সূর্য কন্যা’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘রূপালী সৈকত’, ‘মোহনা’র মতো চলচ্চিত্র। তাঁর তিনটি চলচ্চিত্র ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ‘বাংলাদেশের সেরা ১০ চলচ্চিত্র’-এর তালিকায় স্থান পেয়েছে। ১৯৮৯ সালের ২০ জানুয়ারি হঠাৎ এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় বদলে গেল দিনটা। প্রাণ হারালেন এই প্রথিতযশা নির্মাতা। নেমে এলো শোকের ছায়া। ১৯৩৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর কাওসার চৌধুরী আলমগীর কবিরের জন্ম পার্বত্য নগরী রাঙামাটিতে। তাঁর ডাকনাম ছিল মিন্টু। পিতার চাকরি সূত্রে হুগলিতে থাকায় পড়াশোনা শুরু হয় হুগলি কলেজিয়েট স্কুলে। এরপর দেশভাগের পর ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা লাভের উদ্দেশে ইংল্যান্ড চলে যান। এ সময়ে তিনি ইংগনমার বার্গম্যানের ‘সেভেনথ সিল’ সিনেমা সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি বেশ কয়েকবার চলচ্চিত্রটি দেখেন এবং এ থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতি আকৃষ্ট হন। আলমগীর কবির চলচ্চিত্রশিল্পের ইতিহাস, চলচ্চিত্র পরিচালনা এবং কলাশাস্ত্রের ওপর বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৬ সালে দেশে ফিরে পুরোপুরিভাবে নিয়োজিত হন সাংবাদিকতায়। প্রথমে ‘পাকিস্তান অবজারভার’, এরপর ‘হলিডে’তে। এরপর আলমগীর কবির নিজেই ‘দ্য এক্সপ্রেস’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ধীরে বহে মেঘনা’। ১৯৭৫ সালে নির্মাণ করেন ‘সূর্য কন্যা’। এ চলচ্চিত্রের দক্ষ নির্মাণশৈলীর জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়াও লাভ করেন জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার। ১৯৭৭ সালে নির্মাণ করেন ‘সীমানা পেরিয়ে’। শ্রেষ্ঠ সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৯ সালে নির্মাণ করেন ‘রূপালী সৈকত’। এটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে বাচসাস পুরস্কার লাভ করে।
১৯৮২ সালে নির্মাণ করেন ‘মোহনা’। এ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৮২ সালের মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মোহনা চলচ্চিত্রের জন্য কবির ডিপ্লোমা অব মেরিট লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে নির্মাণ করেন ‘পরিণীতা’। চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়। ১৯৮৫ সালে তিনি নির্মাণ করেন তার সপ্তম ও সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘মহানায়ক’।
আলমগীর কবির তার দেড় যুগের চলচ্চিত্র জীবনে সাতটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও ৯টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন।