আবারও বন্যার মহাবিপদে মানুষ। তলিয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। রাজধানী ঢাকায়ও অবিরাম বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় ভোগান্তিতে পড়েছেন বাসিন্দারা। গভীর নিম্নচাপের কারণে উপকূলীয় জেলা ও চরাঞ্চলে ৪ ফুটের অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। গতকাল এমন পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
আবহাওয়াবিদ খো. হাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে সাগরদ্বীপ ও খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করছে। এটি আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে এবং এরপর ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে পারে। নিম্নচাপের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্রবন্দরসমূহের ওপর দিয়ে দমকা ও ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। বর্তমানে গভীর নিম্নচাপের কারণে কেন্দ্রের ৪৮ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়া আকারে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে।
গভীর নিম্নচাপের কারণে কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
এদিকে অমাবস্যা ও গভীর নিম্নচাপের কারণে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ২ থেকে ৪ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের খবর-
কক্সবাজার : কক্সবাজারসহ সমুদ্রবন্দরগুলোতে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সাগর উত্তাল থাকায় টেকনাফ-সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার-মহেশখালী উপজেলা, মগনামা-কুতুবদিয়া নৌরুটে যান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রশাসন। লোকালয়ে জোয়ারের পানিতে ডুবে দানু মিয়া (৪২) নামের এক মৃগী রোগী মারা গেছেন। জোয়ারের পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট বেড়ে যাওয়ায় বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছিল সৈকতের ঝাউবাগান ও জিও ব্যাগের ওপর। ঢেউয়ের তোড়ে উপড়ে পড়েছে অনেক ঝাউগাছ।
পটুয়াখালী : পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চর মোন্তাজ এলাকার বেড়িবাঁধের বাইরের অন্তত ৩০টি পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
বরিশাল : গতকাল সকাল থেকে বরিশাল-ঢাকাসহ ১২টি রুটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে বলে নৌবন্দর কর্মকর্তা মোহাম্মদ সেলিম রেজা জানিয়েছেন।
নোয়াখালী : বৈরী আবহাওয়ার কারণে দ্বিতীয় দিনের মতো নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সঙ্গে সারা দেশের নৌ চলাচল বন্ধ ছিল।
খুলনা : গতকাল সকাল থেকেই খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া, রূপসা, ফুলতলাসহ বিভিন্ন স্থানে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফসলের মাঠ ও নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।
ভোলা : ভোলার সব রুটে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে নদীবন্দর কর্তৃপক্ষ।
রাজবাড়ী : দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে লঞ্চ ও ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে।
শরীয়তপুর : শরীয়তপুরে বাজারগুলো ছিল ক্রেতাশূন্য। ক্রেতা না থাকায় অনেকেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যান।
চাঁদপুর : চাঁদপুরে খেটে খাওয়া মানুষ পড়েছেন বিপাকে। নদনদীর পানি কিছুটা বেড়েছে এবং নদীতে স্রোত ও ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
পিরোজপুর : জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে মঠবাড়িয়া উপজেলার মাঝেরচর, বড়মাছুয়া, ছোটমাছুয়া, শাপলেজা, খেতাচিড়া, ভান্ডারিয়া উপজেলার চরখালী, তেলিখালী, ইন্দুরকানি উপজেলার সাউথখালী চর, চরখালী, কাউখালী উপজেলার সোনাকুর এলাকায় দেড় থেকে দুই ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
কলাপাড়া (পটুয়াখালী): নিম্নচাপের প্রভাবে উত্তাল বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের তা বে ভেঙে গেছে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার নির্মাণাধীন মেরিন ড্রাইভ সড়ক। পাশাপাশি দমকা হাওয়ায় সমুদ্রতীরে গাছপালার ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। ভেঙে গেছে অর্ধশত কাঁচা ঘরবাড়ি। এ ছাড়া ওয়াপদা বেড়িবাঁধের বাইরে শত শত ঘরবাড়ি, দোকানপাট জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
বাগেরহাট : বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়ার পাশাপাশি ৬ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেছে গোটা সুন্দরবন। কটকা-কচিখালা, দুবলা, শেলারচরসহ সমুদ্র উপকূলের বন ৬ ফুট পানির নিচে তলিয়ে থাকলেও সুন্দরবনের সব থেকে উচু এলাকা চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন ও পর্যটন কেন্দ্রটিও ৮০ সেন্টিমিটার পানিতে তলিয়ে রয়েছে। এ অবস্থায় গতকাল দুপুরে জলোচ্ছ্বাসে দুবলারচরে মারা গেছে একটি হরিণ। শেলারচর টহল ফাঁড়ি এলাকার নদী থেকে ভেঁসে যাওয়া একটি হরিণও উদ্ধার করেছে বনরক্ষীরা। সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জ কর্মকর্তা রানা দেব জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে গতকাল দুপুরে ৬ ফুট জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবন তলিয়ে গেছে। পানিতে সুন্দরবনের বিভিন্ন টহল ফাঁড়ির অফিস ব্যারাক কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানির তীব্র স্রোতে শেলারচর থেকে একটি হরিণ ভেসে যাওয়ার সময় বনরক্ষীরা তা দেখতে পেয়ে হরিণটিকে উদ্ধার করে। পরে উদ্ধারকৃত হরিণকে সুন্দরবনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে দুবলারচরে মারা গেছে হরিণ। পর্যটন স্পট কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরেস্টার আবদুস সবুর বলেন, জলোচ্ছ্বাসে কটকার বন ৬ ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। এ সময় অনেক হরিণ কটকা ফরেস্ট অফিসের পুকুরপাড়সহ উঁচু জায়গায় এসে নিরাপদ আশ্রয় নেয়।