কেমন আছে বাংলাদেশ? কিংবা কেমন আছে বাংলাদেশের মানুষ? প্রথম প্রশ্নের জবাব খুব স্পষ্ট করে লিখে দেওয়া সহজ নয়। তবে দেশের মানুষ খুব বেশি ভালো নেই। সবাই কি ভালো নেই? তা কেন? ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে কিছু লোক তো অবশ্যই খুব ভালো আছে। কিছু লোক খুব বেশি ভালো না থাকলে বেশির ভাগের পক্ষে খারাপ থাকতে পারা কঠিন। এর একটা তাত্ত্বিক ভিত্তিও আছে। অত তত্ত্বকথার কাজ নেই। সোজাসাপ্টা কথা; আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা ভালো নেই। জেনারেশন জির কাছে আমরা অনেক কিছু আশা করেছিলাম। সাধারণ মানুষ আশায় বুক বেঁধে ছিলেন, জেন জি তথা আমাদের নির্ভয় প্রজন্ম মানুষের সব গ্লানি মোচন করে দেবে। নীলকণ্ঠের মতো সমাজের সব বিষ শোষণ করে নেবে। কিন্তু সে আশা আজ নিরাশায় পর্যবসিত হতে চলেছে।
ঘরে-বাইরে, অফিসে, রাজপথের কোথাও শান্তি নেই। ‘শান্তির ললিতবাণী শোনাইছে ব্যর্থ পরিহাস।’ জিনিসপত্রের দাম মোটামুটি ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকলেও গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে নাকাল মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষ। বিদ্যুৎ এক ঘণ্টা থাকে তো দুই ঘণ্টা থাকে না। পল্লী বিদ্যুতের অবস্থা যে কতটা খারাপ, তা ব্যাখ্যা করে বোঝানো কঠিন। বিদ্যুতের টালবাহানায় গার্হস্থ্য জীবন বিপর্যস্ত। সাপ্লাইয়ের গ্যাস থাকে তো ফ্লো থাকে না। দিনের বেলায় গ্যাসই পাওয়া যায় না। কোনো এলাকায় নাকি দিনের রান্না করতে হচ্ছে গভীর রাতে। এলপি গ্যাসও সস্তা নয়। একই কারণে সংকট দেখা দিয়েছে ব্যবসাবাণিজ্য ও কলকারখানায়। গ্যাস-বিদ্যুতের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় কর্মীদের ওভারটাইম দিতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে লোকসানের মধ্যে পড়াই স্বাভাবিক। শ্রমিক অসন্তোষ তো লেগেই আছে।
বিশ্বনন্দিত নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কূটনীতির ৩৬০ ডিগ্রি সাফল্যগাথায় জাতি হিসেবে আমরা গৌরবান্বিতবোধ করি। সরকারি বার্তা সংস্থা এ নিয়ে ফেনায়িত রিপোর্ট করতে পারে। বিশ্ববলয়ে আমাদের এখন মিত্রের অভাব নেই। বাণিজ্য প্রসার ও বিনিয়োগের নতুন নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। হবে-হচ্ছে অনেক কিছু। কিন্তু ঘরের শান্তি, সেটাই তো হচ্ছে না। বাসাবাড়ি, ব্যবসাকেন্দ্র ও কলকারখানায় গ্যাস-বিদ্যুতের বিরাজমান সংকটের দিকে মনোযোগ দেওয়ার দাবি যেন বা আজ গৌণ হয়ে পড়েছে। আস্থার সংকট প্রকাণ্ড হচ্ছে। ইন্টেরিম ও জেনারেশন জির প্রতিনিধিত্বকারী এনসিপির গতিমুখ কোন দিকে? তারা কি সময় নিয়ে সংস্কার সম্পন্ন করে অতি ভালো ইলেকশনের মাধ্যমে বিলম্বিত সাচ্চা গণতন্ত্র উপহার দিতে চাইছে? নাকি গত হয়ে যাওয়া ফ্যাসিবাদের সাড়ে ১৫ বছরের যে কালপর্ব, তার পরে আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারবাদী ইন্টেরিম বন্দোবস্ত চাইছেন? অন্তর্বর্তী শব্দটার মধ্যেই একটা পাজল আছে। এ একটা ধাঁধা। এর মধ্যে ইকুইভোকেশন অর্থাৎ দ্ব্যর্থবোধকতা রয়েছে। দুটো মেয়াদের মাঝখানে যে সময় সেটাকে বলা হয় অন্তর্বর্তী। রাজনৈতিক পরিভাষায় একটি সরকারের অবসানের পর আরেক মেয়াদের সরকার আসার মধ্যবর্তী সময়। এই সময় কয় মাস, তার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। ১৯৯৬ সালের স্বল্পস্থায়ী পার্লামেন্টে গৃহীত আইন অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন মাস। কিন্তু ২০০৭ সালের লগিবৈঠার প্রাণঘাতী গোলযোগের প্রেক্ষাপটে যে সরকার এসেছিল, সেটা নিরেট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না। সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সে সরকারের নাম দেওয়া হয়েছিল সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কাজেই ওই সরকারকে ’৯৬ সালের আইনের ধার ধারতে হয়নি। সেনাসমর্থিত সেই সরকারও সংস্কারের সেøাগান দিয়েছিল। রাজনীতি থেকে তারা পরিবারতন্ত্র উচ্ছেদের মাধ্যমে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল। সেটা করতে গিয়ে আব্দুল জলিল ও আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার মতো জেন্টলম্যান লিডারদের কপাল পুড়েছিল। তাঁরা না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে গিয়েছিলেন। বিচার বিভাগ পৃথককরণ, জাতীয় পরিচয়পত্র ইত্যাদি সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছিল সেই সরকার। সেজন্য কমিশন গঠন করার দরকার হয়নি। বিচার বিভাগ পৃথককরণ পুরোপুরি সম্ভব না হলেও সামান্য অগ্রগতি বোধ হয় হয়েছিল। তবে কোনো কমিশন-টমিশন ছাড়াই ওই সরকার এনআইডি প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করেছিল। মইন ইউ আহমেদ ও ফখরুদ্দীন সরকার ধানাইপানাই করে দুই বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল। এনআইডি স্কিম বাস্তবায়ন করে ওই সরকার একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করতে পেরেছিল। এটা ইতিহাসের সত্য।
কিন্তু বর্তমান ইন্টেরিম সরকার সংস্কার সংস্কার করে বেশ একটা আলোড়ন তুলতে পারলেও কোথাও কোনো দৃশ্যমান সংস্কার হয়নি। সংস্কার সুপারিশ তৈরি করার জন্য সরকার বাছা বাছা বিশেষজ্ঞ ডেকে এনে অনেকগুলো কমিশন গঠন করে দিয়েছে। কমিশনগুলো তাদের মতো করে জনমত যাচাই ও চিন্তা ফিকির করে সুপারিশ বানিয়ে সরকারপ্রধানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেছে। পত্রিকা ও টেলিভিশনে সচিত্র খবর প্রকাশ ও প্রচার হয়েছে। এরই মধ্যে আবার এসেছে জুলাই সনদ ঘোষণার দাবি। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি ও ঘোষণার নিমিত্ত একটি হাই প্রোফাইল কমিশন গঠন করা হয়েছে, যার সভাপতি স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কমিশনের সহসভাপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করে যাচ্ছেন। তিনি শুরুর দিকে জাতীয় ঐকমত্যের প্রশ্নে বেশ আশার বাণী শোনাচ্ছিলেন। কিন্তু ইদানীং মনে হয় খানিকটা হতাশ। যখন তিনি বলেন যে ঐকমত্য না হলে সব কিছু জানিয়ে তিনি চলে যাবেন, তখন স্পষ্টতই কানে বাজে হতাশার সুর। সংস্কার ও জুলাই সনদ ঠিক কবে নাগাদ হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। দেশে জেনারেল ইলেকশন কবে হবে; এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নাকি আগামী বছরের জুনের মধ্যে, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না।
দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি ও সমমনা পার্টিগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে ইলেকশন চাইছে। এখন তাদের সেই দাবি আরও জোরালো হয়েছে। গত বুধবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তারুণ্যের সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরেই নির্বাচন হবে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা চলছে। মনে হয় সরকারের কোনো ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।’ অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিপক্ষ বানাবেন না। জনগণের বিশ্বাস ও ভালোবাসা নষ্ট হয়, এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ঠিক হবে না।
এই কঠোর বার্তায় সরকারের প্রতিক্রিয়া কী, তা এখনো জানা যায়নি। তবে প্রধান উপদেষ্টা দেশে ও বিদেশে পূর্বাপর বলে আসছেন যে আগামী বছরের জুনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে সব কথা শুনে শেষমেশ বলেছেন, আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। বিএনপি ছাড়াও সমমনা দলগুলো ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইছে। কমিউনিস্ট পার্টিরও দাবি ডিসেম্বরে নির্বাচন। সেনাবাহিনীও ডিসেম্বরে ইলেকশনের পক্ষপাতী। সেনাপ্রধান একাধিকবার এ কথা বলেছেন। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সরকার মনে হয় তাঁদের সিদ্ধান্তে অবিচল।
এদিকে এনসিপির দাবি জাতীয় সংসদের আগে কিংবা একই সঙ্গে গণপরিষদেও ইলেকশন দিতে হবে। অর্থাৎ তারা চাইছে পার্লামেন্টের পাশাপাশি গণপরিষদ হবে, যারা সংবিধান প্রণয়ন করবেন। এই জায়গায় ধোঁয়াশা তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। গণপরিষদের কাজ সংবিধান প্রণয়ন করা। গণপরিষদ সরকার গঠন করে না। সরকার গঠন করবে জাতীয় সংসদ। কিন্তু গণপরিষদ যখন সংবিধান তৈরির কাজ করবে তখন জাতীয় সংসদ কী করবে? পার্লামেন্ট তখন ঝুলে থাকবে নাকি কার্যকর হয়ে যাবে? নাকি নতুন সংবিধান না হওয়া পর্যন্ত পার্লামেন্ট ঝুলেই থাকবে? সংবিধান হওয়ার আগেই কি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে? এসব প্রশ্নেরও জবাব পরিষ্কার হওয়া উচিত। নির্বাচিত পার্লামেন্টকে কাজ করতে না দেওয়ার দৃষ্টান্ত তো আমাদের ইতিহাসেও আছে। একটি দেশের শাসনতন্ত্র সংশোধন-পরিমার্জনের জন্য যেখানে একটি পার্লামেন্টই যথেষ্ট সেখানে কেন গণপরিষদের দাবি তোলা হচ্ছ? ১১ মে ঢাকায় এক আলোচনা সভায় আইন উপদেষ্টা বলেছেন, একটা দেশের নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে দুই-তিন বছর সময় লাগতে পারে। কোনো কোনো দেশে ৮-৯ বছরও লেগেছে। আইন উপদেষ্টার এই বক্তব্য চলমান বাস্তবতায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এনসিপির গণপরিষদ গঠনের দাবি, আইন উপদেষ্টার বক্তব্য এবং আরও দুয়েকজন উপদেষ্টার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য সর্বোপরি বিলম্বিত ইলেকশনের পরিকল্পনা-এগুলোর মধ্যে কোনো যোগসূত্র থাকা বিচিত্র নয়। সে ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্যের যে আকাক্সক্ষা, তা ভেস্তে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা আজ অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক