১৯৯২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ রচিত বরকত উল্লাহ নির্দেশিত জনপ্রিয় বাংলা নাটক এটি। নাটকটি দর্শকমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। ধারাবাহিকটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল ‘বাকের ভাই’। বাকের ভাই গুন্ডা প্রকৃতির লোক এবং তার সঙ্গী ছিল বদি ও মজনু। বাকের ভাইকে পছন্দ করত মুনা।
মুনা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাকের ভাই এলাকার মাস্তান হলেও অধিকাংশ মানুষ তাকে ভালোবাসত। কারণ, সে ছিল সত্যের পূজারি। নিপীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে যেমন কুণ্ঠিত হতো না, তেমনি সমাজের অন্যায়কেও মুখ বুজে মেনে নিত না। ঘটনাচক্রে বাকের ভাই একদিন মিথ্যা খুনের দায়ে অভিযুক্ত হয়। আদালত ওই খুনের দায়ে নির্দোষ বাকের ভাইকে মিথ্যা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দেন। নাটকের এই পরিণতি কাঁদিয়েছিল লাখো ভক্তকে। এমনকি এই ফাঁসি যাতে কার্যকর না হয়, সে জন্য রাস্তায় আন্দোলনেও নেমেছিল দর্শক। চলতে থাকে মিছিল, দেয়াল লিখন ও সমাবেশ। এসব খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে। বাকের ভাইয়ের পক্ষে দর্শকের তুমুল আবেগ ও সমর্থন সত্ত্বেও ধারাবাহিকে তার ফাঁসি কার্যকর হয়।
ধারাবাহিকটির তুমুল জনপ্রিয়তার ছায়া পড়ে বাকের ভাই চরিত্রের অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের জীবনেও। তিনি এর পর থেকে বাকের ভাই হিসেবে সমাদৃত হন। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি ঠেকাতে রাস্তায় নেমেছিলেন সাধারণ মানুষ। রমনা থানায় নিরাপত্তা চাইতে হয়েছিল নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ এবং এর প্রযোজককেও। করা হয় জিডি। নাটকে বাকের ভাইয়ের প্রধান সঙ্গী বদি ভাই মানে প্রয়াত অভিনেতা আবদুল কাদের বাকের ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যে সাক্ষী দিয়েছিলেন। এই সাক্ষী দেওয়ার অপরাধে বদির বিরুদ্ধেও জনতা স্লোগান দেয়, মিছিল বের হয়। তাকে উদ্দেশ করে এরকম স্লোগান দেওয়া হয়, ‘বদি তুমি সাক্ষী দিলে ভাসবে তুমি খালে বিলে।’ এমনকি তার বাসার সামনেও পোস্টার ছাপা হয়। বাকের ভাইয়ের ফাঁসির দিনে চারদিকে যখন বাকের ভাইয়ের পক্ষে মিছিল-স্লোগান, তখন নাটকের শিল্পীরা হুমায়ূন আহমেদকে বলতেন যেন ফাঁসি না হয়। কিন্তু হুমায়ূন ভাই দুষ্টুমি করতেন। তিনি ভাষণের মতো বলতেন, বাকেরের ফাঁসি কেউ আটকাতে পারবে না।
বাকের ভাইয়ের ফাঁসির দিন সন্ধ্যার পর থেকেই সারা শহর রীতিমতো শ্মশান হয়ে যায়। সবাই টিভির সামনে বসে যায়।
দেশে একেবারে কারফিউয়ের মতো অবস্থা ছিল। যেদিন বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হলো সেদিন হুমায়ূন আহমেদ নিজের বাসায় থাকলেন না। অন্য কোথাও ছিলেন। তার বাসা ঘিরে ফেলেছিল মানুষ। আবদুল কাদেরের বাসায় ফোন আসতে থাকে। হুমকি দেওয়া হয় তাকে। বলা হয় রাস্তায় বেরোলে তার গাড়ি ভেঙে ফেলবে। একটা নাটক নিয়ে এমন উন্মাদনা ছিল মানুষের মধ্যে। নাটকে প্রধান চরিত্রগুলো বাকের ভাই, মুনা, বদি, মজনু ও মতি চরিত্রে যথাক্রমে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর, সুবর্ণা মুস্তাফা, আবদুল কাদের, জর্জ, মাহফুজ আহমেদ।