চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে লাখো কোটি টাকার কাছাকাছি ৯৮ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি। এই ঋণ প্রবৃদ্ধির হার গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সম্প্রতি প্রকাশিত পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)-এর সামষ্টিক অর্থনৈতিক আউটলুকে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন বাজেট (এডিপি) বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মেগা প্রকল্পের কাজ বন্ধ। তাহলে এত ঋণ নিয়ে কী করছে সরকার- প্রশ্ন উঠেছে সে বিষয়ে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের ঋণের মূল কারণ বাজেট ঘাটতি মেটানো। এর বাইরে বড় ধরনের কোনো দুর্যোগ ঘটলে বা অপ্রত্যাশিত ব্যয় বেড়ে গেলে সরকারের ঋণের পরিমাণ বাড়তে পারে। তবে চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন হার খুব বেশি নয়; বরং উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন হার এ যাবৎকালের মধ্যে নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)-এর বরাত দিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলেছে, চলতি অর্থবছরের (জুলাই-এপ্রিল) মূল বাজেট বরাদ্দের বিপরীতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার ৩২ দশমিক ৮ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর মধ্যে সরকারের অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নের হার ৩১ দমমিক ১ শতাংশ ও উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন হার ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছর সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া শীর্ষ ১০ মন্ত্রণালয়/বিভাগের মধ্যে পাঁচটির এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল গড় হারের তুলনায় কম। অপরদিকে শীর্ষ দশের বাইরে থাকা সরকারি মন্ত্রণালয়/বিভাগগুলোর গড় এডিপি বাস্তবায়ন হার গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ৪২ দশমিক ৪ শতাংশ চলতি অর্থবছরে তা কমে ২১ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। আবার সামগ্রিক বাজেট বাস্তবায়ন হারও গত অর্থবছরের তুলনায় খুব একটা বাড়েনি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের সাত মাসে সামগ্রিক বাজেট বাস্তবায়ন হার ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ১ শতাংশ পয়েন্টে বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বাজেট বাস্তবায়ন হার ছিল ৩২ দশমিক ৪ শতাংশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ও মাহবুব আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারের ঋণ গ্রহণের বড় কারণ বাজেট ঘাটতি মেটানো। কিন্তু চলতি অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন হার খুবই কম। অনুন্নয়ন বাজেটেও অপ্রত্যাশিত কোনো খাত তৈরি হয়নি যার জন্য বড় ধরনের অর্থের প্রয়োজন হতে পারে; এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে ব্যাংক থেকে এত টাকা নিয়ে সরকার কী করল।’ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক এই বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মনে করেন, সরকারের রাজস্ব আয় কমার কারণেই ব্যাংক ঋণ বাড়তে পারে। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রিও কমেছে। এতে করে সরকারের অর্থ জোগানের পথগুলো সংকীর্ণ হয়ে গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব আদায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার যে টাকা পেয়েছে, তার চেয়ে ৭ হাজার ১৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে। সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙার হার বেশি হওয়ায় এই খাত থেকে সরকারের অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না। মাহবুব আহমেদ জানান, রাজস্ব আয় কমবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ ব্যবসাবাণিজ্য স্থবির হয়ে গেছে। অর্থনীতির কোনো খাতে গতি নেই। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাপনের ব্যয় বাড়ায় সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। এ পরিস্থিতিতে আয়ের সঙ্গে ব্যয় সামাল দিতে বাজেটও কাটছাঁট করেছে সরকার। সে কারণেই ৬০ শতাংশ বেশি ব্যাংক ঋণ নিয়ে ওই টাকা কোথায় খরচ করা হলো তা কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। ব্যয়ের খাতগুলো যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে না বলে মনে করেন সাবেক এই অর্থ সচিব। এ বিষয়ে জানতে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও অর্থ সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। মোবাইলে মেসেজ পাঠালেও উত্তর পাওয়া যায়নি।