খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বক্তৃতা করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই মজার মজার গল্প বলতেন। কারও অসংলগ্ন কথাবার্তার উদাহরণ দিতে তিনি বলতেন “একজন কবিতা লিখল- ‘এই পাড় থাইক্কা মারলাম ছুরি, লাগল কলা গাছে/হাঁটু ফাইট্টা কান্দন আহে, চোখ গেল রে বাবা।’ এই কবিতার যেমন কোনো অর্থ নেই, আবার তার কথারও কোনো মানে নেই।” তাঁর বলা আর একটি গল্প ‘উজানির মার গল্প’। সেটা এরকম-এক গ্রামে একজন অত্যন্ত ঝগড়াটে মহিলা ছিল। পাজির পা-ঝাড়া যাকে বলে। ঝগড়াটে হিসেবে এলাকায় তার বেশ পরিচিতিও ছিল। জিহ্বা তার এতই তীক্ষè ছিল যে তার সঙ্গে কেউ লাগতে গেলে অক্ষত মান-ইজ্জত নিয়ে ফেরত আসা দুষ্কর ছিল। তাই সহজে কেউ তাকে ঘাটাতে চাইত না। মহিলার স্বভাবের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল-সবাই যেটা বলবে, সে তার উল্টোটা বলবে, উল্টো কাজটি করবে। মহিলার অত্যাচারে তার স্বামী ছিল অতিষ্ঠ। স্বামী যা বলত, সে করত তার বিপরীত কাজ। অর্থাৎ সে সব সময় উজানে চলত। উজানে চলার এ খাসলত দেখে গ্রামবাসী তার নাম দিয়েছিল ‘উজানির মা’। মহিলা প্রায় প্রতিদিনই স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করত। একদিন ঝগড়ার সময় ত্যক্তবিরক্ত স্বামী তাকে বেদম প্রহার করল। এরপর সে চলে গেল মাঠে কাজ করতে। এদিকে বউটি মনের দুঃখে ঝাঁপ দিল নদীতে। খবর পেয়ে স্বামী এসে বউকে খুঁজতে শুরু করল নদীর উজানের দিকে। লোকজন বলল, ‘তুমি করছ কী হে মিয়া? পানিতে ঝাঁপ দিছে, লাশ কি উজানে যাইব? ভাটিতে খোঁজ।’ বিষণ্নবদনে স্বামীটি বলল, ‘সারা জীবন যে উজান ঠেলছে, মইরা কি সে ভাটিতে যাইব?’ অনেক খোঁজাখুঁজির পর উজানে লাশ না পেয়ে লোকটি ভাটিতে খুঁজতে লাগল। মাইল দুয়েক ভাটিতে গিয়ে নদীর পাড়ের এক ঝোঁপের সঙ্গে আটকে থাকা বউটির লাশ পাওয়া গেল। তখন স্বামীটি বলতে লাগল, ‘আরে উজানির মা, সেই তো ভাইট্টান ভাইট্টাইলি, বাঁইচ্চা থাকতে ভাইট্টাইলি না।’ মোয়াজ্জেম ভাই গল্পটি বলেছিলেন, রাজধানীর মুক্তাঙ্গনে বিএনপির এক জনসভায়। গল্পটি বলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে আছেন আরেক উজানির মা। সবাই চাচ্ছে তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকার, উনি দেবেন না। সবাই বলছে একটু ভাটিতে চলেন, উনি উজান ঠেলছেন। উজানির মা, বেশি উজাইয়েন না। ভাটার টান শুরু হইলে কিন্তু রেহাই পাইবেন না। এই দেশটা তো জোয়ার-ভাটার দেশ। একটু ভাটিতে নামেন। আমাদের দাবিগুলো শোনেন, ঠান্ডা মাথায় ভাবেন, মানেন। না হলে ভাটার টানে এমন নিচে যাইবেন, আর উজানের টাইম পাইবেন না।’ এর কয়েক দিন পরে তাঁর গুলশানের বাসায় একান্ত আলাপচারিতায় তাঁকে বললাম, ‘ভাই, উজানির মা কি আদতেই ভাটার টানে পড়বে?’ মোয়াজ্জেম ভাই কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনার উদাহরণ দিয়ে বললেন, “পৃথিবীর কোনো নদীতে কি চিরকাল জোয়ারই আসে? ভাটা আসে না? জোয়ার-ভাটা হয় চাঁদের অমাবস্যা-পূর্ণিমার কারণে সেটা তুমি জানো। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার বেঁধে দেওয়া নিয়মে। শুধু নদীর জোয়ার-ভাটা নয়, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু তাঁরই ইচ্ছা ও ইশারায় পরিচালিত হয়। আজ হোক, কাল হোক, আমার ‘ভাতিজি’ হাসিনার নদীতে ভাটার টান আসবেই। হয়তো সেদিন আমি এই পৃথিবীতে না-ও থাকতে পারি।” আমি বললাম, ‘ভাই আমরা দোয়া করি, সেই দিনটি যেন আপনি সচক্ষে দেখতে পারেন।’ আমাদের অনেকের সে দোয়া কাজে লাগেনি। মোয়াজ্জেম ভাই ইহলোক ত্যাগ করেন ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। আর হাসিনার ক্ষমতার নদীতে ভাটার টান আসে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে।
শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলা মোয়াজ্জেম ভাইয়ের গল্পটি একেবারে হুবহু মিলে গেছে। একটানা সাড়ে ১৫ বছর কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে, কাউকে পাত্তা না দিয়ে উজানির মায়ের মতো একগুঁয়ে আচরণ করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন ক্ষমতার নদীতে যে জোয়ারে তিনি তরি ভাসিয়েছেন, সে নদীতে কখনোই আর ভাটা আসবে না। কিন্তু জাতীয় কবি কাজী নজরুল তাঁর গানে বলে গেছেন, ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়,/আজ যে রাজাধিরাজ, কাল সে ভিক্ষা চায়।’ মনীষীদের বাণী তো মিথ্যে হতে পারে না। তাই শেখ হাসিনার ক্ষমতার নদীতে এমন ভাটার টান এলো, তাঁকে নিয়ে ফেলল একেবারে দেশের বাইরে। সেখান থেকে তিনি আর সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসতে পারবেন কি না, আল্লাহ মালুম।
বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কস, যিনি সমাজতন্ত্রতত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা, তাঁর অসংখ্য কালজয়ী উক্তির একটি হলো-‘এটাই ইতিহাসের শিক্ষা যে কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না।’ অবশ্য এ নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে। অনেকের মতে, উক্তিটি জার্মান দার্শনিক জর্জ হেগেলের। তবে উক্তি যারই হোক, এর মর্মার্থ নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ বা সংশয় প্রকাশের অবকাশ নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু ক্ষমতাশালী শাসকের পতনের নজির রয়েছে। সেসব পতনের সাক্ষী এই পৃথিবী নামের গ্রহটির বাসিন্দারাই। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, চোখের সামনে সেসব ঘটনা ঘটতে দেখেও কারও বোধোদয় হয় না। আমরা যখন স্কুল-কলেজের ছাত্র, বিক্রমপুরের শ্রীনগর থেকে ঢাকায় যাতায়াত করতাম লঞ্চে। যাওয়া-আসার পথে লঞ্চে দেখতাম হকার একটি চটি বই বিক্রি করত ‘কী করিলে কী হয়’ নামে। ৫০ পয়সা মূল্যমানের ওই চটি পুস্তিকাটি ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। তাতে লেখা ছিল কোন কাজটি করলে তার কী ফল ভোগ করতে হয়। আমার মনে হয়, কেউ যদি ওই পুস্তিকাটিতে উদ্ধৃত উক্তিসমূূহ মেনে চলে, তাহলে সহজেই সে অনাকাক্সিক্ষত বিপদ-আপদ এড়িয়ে চলতে পারে। শিশুকালে আমাদের লেখাপড়া শুরু হতো বেণীমাধব দাস প্রণীত ‘বর্ণবোধ’, তারপর সীতানাথ বসাক প্রণীত ‘আদর্শ লিপি ও বর্ণ পরিচয়’ বই দিয়ে। শেষোক্ত বইটিতে প্রতিটি বাংলা অক্ষর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি কিছু উপদেশবাণীও আছে। সেখানে ‘উ’ অক্ষরে লেখা ছিল ‘উগ্রভাব ভালো নয়’। এই উক্তির যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। কেননা, উগ্রতা মানুষকে কখনো কখনো প্ররোচিত করে হিংসাত্মক হয়ে উঠতে; যা একসময় তাকে নিয়ে যায় পতনের গিরিখাদের কিনারায়। মানুষের এই প্রবণতাকে আমরা গল্পের উজানির মায়ের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। মানুষ যখন উগ্রতার দ্বারা পরিচালিত হয় কিংবা জিঘাংসা চরিতার্থ করতে প্রতিজ্ঞ হয়, তখনই সে চলতে শুরু করে উজানে। অর্থাৎ সব যুক্তিতর্ক নীতি-নৈতিকতা তার কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়ে। অন্যের ভালো পরামর্শও তার কাছে হয়ে পড়ে মূল্যহীন। সে যেটাকে সঠিক মনে করে, সেটাই বাস্তবায়ন করতে চায়। আর তা করতে গিয়ে চরম বর্বরতার আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করে না। এই উন্মত্ততা বা উজানোর পেছনে মূল কারণ ক্ষমতার দম্ভ। ক্ষমতা এমনই একটি মাদক যে এই নেশাদ্রব্যটিতে যে একবার আচ্ছন্ন হয়, তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। গত বছর সংঘটিত জুলাই গণ অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি পালিত হচ্ছে। আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত তা চলবে। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্মরণ করবে গত বছরের ঐতিহাসিক গণ আন্দোলনের কথা, হাসিনা সরকারের নৃশংসতার কথা। সে আন্দোলন কেন সংঘটিত হয়েছিল, কীভাবে তা গণ অভ্যুত্থানে রূপ নিল, তা নিয়ে নানা জন নানা অভিমত দেবে, ব্যাখ্যা করবে। তবে আমি মনে করি, সে গণ অভ্যুত্থানের পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘উজানির মায়ের’ চরিত্র। ২০০৯ সালে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নানা কুটচালের ফলে ক্ষমতাসীন হওয়া আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা হয়ে পড়েন বেপরোয়া। নীলনকশার জাতীয় সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হাতে পেয়ে নিজেকে ভাবতে থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। লিপ্ত হন বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক ও মানবাধিকার হরণে। ক্ষমতালিপ্সা তাঁকে এতটাই বেপরোয়া করে তোলে যে নিজেদের আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতেও দ্বিধা করেননি। বিএনপিসহ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো আপত্তি জানিয়েছে, আন্দোলন করেছে। কিন্তু সেসবকে ধর্তব্যের মধ্যে নেননি শেখ হাসিনা। ক্ষমতার মসনদকে চিরস্থায়ী ভেবে যা খুশি করেছেন, বলেছেন। একবারও ভেবে দেখেননি, বায়ু সব সময় একদিক থেকে প্রবাহিত হয় না।
শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে বিএনপিকে ব্যাপৃত থাকতে হয়েছে রাজপথে। দলটির নেতা-কর্মীরা হামলা-মামলা, খুন-গুমের শিকার হয়েছেন। আন্দোলন দানা বেধে উঠতে পারেনি সরকারের জুলুমবাজির কারণে। ফলে বিএনপির আন্দোলন কোনো পরিণতি পায়নি। এর পেছনে অবশ্য দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না। বিএনপির সে সাংগঠনিক দুর্বলতারই সুযোগ নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সামনে কোনো শক্ত বাধা নেই-এ বিবেচনায় তিনি পরিণত হয়েছিলেন গল্পের উজানির মায়ে। কিন্তু নিয়তি বড় নিষ্ঠুর। শেখ হাসিনা যখন নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে ক্ষমতা চিরকুক্ষিগত করার ভাবনায় মগ্ন ছিলেন, নিয়তি বোধ করি আড়ালে তখন মুখ টিপে হাসছিল। ‘পচা শামুকে পা কাটা’র মতো শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত তাঁর পতন ঘটায়। সবারই স্মরণ থাকার কথা, শিক্ষার্থীদের সে আন্দোলনকেও তিনি এবং তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে উপহাস করেছিলেন। এখানেও আমরা উজানির মায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করি।
শেখ হাসিনা হয়তো ভেবেছিলেন ১৫ বছর তিনি যেভাবে বিএনপিকে দমিয়ে রেখেছেন, সেভাবেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে দমন করে ফেলবেন। কিন্তু অঙ্ক কষতে ভুল করেছিলেন তিনি। সব ওষুধ যেমন সব রোগ সারায় না, তেমনি সব অস্ত্র সব সময় কার্যকর হয় না। মগজাস্ত্রের পরিবর্তে তিনি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মারণাস্ত্রের ব্যবহার করলেন। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের আর কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে এমন নৃশংস নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ হয়নি। স্বৈরশাসক এরশাদকে হটাতে ৯ বছরে শহীদ হয়েছিলেন ১৭৭ জন। আর চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে শেখ হাসিনার পেটোয়া বাহিনী এক দিনে তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। জুলাই আন্দোলন দমাতে শেখ হাসিনার বাহিনীগুলো মোট গুলি ছুড়েছে ৩ লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড। এর মধ্যে শুধু ঢাকাতেই ছোড়া হয়েছে ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড। সিংহাসন আঁকড়ে থাকার জন্য কতটা উন্মত্ত হয়ে উঠলে একজন শাসক তাঁর দেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর এমন বেহিসাবি গুলিবর্ষণের হুকুম দিতে পারেন, তা সহজেই অনুমেয়। বলাটা অত্যুক্তি হবে না, মানুষের রক্তস্রোতের উজান ঠেলে সংকটের সমুদ্র পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু বিধিবাম। ততক্ষণে ভাটার টান শুরু হয়ে গেছে। অতঃপর সে ভাটার টান ৫ আগস্ট তাঁকে নিয়ে ফেলল এমন ভাটিতে, যেখান থেকে উজিয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। শেখ হাসিনার এই পরিণতি ভবিষ্যতে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবে তাদের জন্য একটি শিক্ষা। ক্ষমতার মদমত্ত হিংস্র শাসকের পরিণতির উদাহরণ হয়ে থাকবেন তিনি।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক