ইসলামের ইতিহাসে যখনই সত্য ও মিথ্যার সংঘাতের কথা আসে তখন অবধারিতভাবে কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা এবং ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের কথা উঠে আসে। একদিকে ছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র, ন্যায়ের প্রতীক ইমাম হুসাইন (রা.), অন্যদিকে পাপাচার, স্বৈরাচার ও নৃশংসতার প্রতিমূর্তি ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া। ইয়াজিদের সংক্ষিপ্ত শাসনকাল ছিল ইসলামের ইতিহাসের এক অন্ধকারতম অধ্যায়, যা কেবল কারবালার প্রান্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তার হিংস্রতা ছড়িয়ে পড়েছিল ইসলামের পবিত্র নগরী মদিনা ও মক্কা পর্যন্ত। তার ওপর বর্ষিত হয় ইতিহাসের অনন্ত লানত বা অভিশাপ।
ইসলামের শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি শুরা বা পরামর্শভিত্তিক খেলাফতব্যবস্থার পরিবর্তে ইয়াজিদ বাছাই করে নিয়েছিলেন স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বৈরতন্ত্রকে। চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর শাহাদাতের পর থেকেই ছন্দপতন হয় ইসলামি খিলাফতের। মুয়াবিয়া (রা.)-এর আপ্রাণ চেষ্টার বদৌলতে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা কিছুটা নিয়মতান্ত্রিক হলেও সে ব্যবস্থায় চরম আঘাত হানেন দুরাচারী ইয়াজিদ। ইয়াজিদ তার দুরাচারী মনোভাব লুকিয়ে রাখার কারণে সাহাবি হজরত মুয়াবিয়া (রা.) ইজতিহাদ করে ইসলামের বৃহৎ স্বার্থের কথা বিবেচনা করে অযোগ্য ও দুশ্চরিত্র পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী শাসক হিসেবে মনোনীত করেন। এটা ছিল মুয়াবিয়া (রা.)-এর ইজতিহাদিতা খাতা বা গবেষণাগত ভুল। তা ছাড়া ঐতিহাসিকদের মতে, মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের নিয়তেই তিনি ইয়াজিদকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। যদিও ইয়াজিদের চরিত্রের খারাবি সম্পর্কে তিনি ভালোভাবে অবগত ছিলেন না। কিন্তু এ কথা অস্বীকারের সুযোগ নেই যে ইয়াজিদের ক্ষমতারোহণের মাধ্যমে ঘৃণ্য রাজতন্ত্রের সূচনা হয়।
ইয়াজিদ ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন চরম মাত্রার পাপাচারী। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি মদ্যপান, নারীলোলুপতা, গানবাজনা এবং এমনকি বানর ও কুকুর নিয়ে খেলায় মত্ত থাকতেন। (ইবনে সাদ, তাবাকাতুল কুবরা ৭ম খণ্ড, ৭০ পৃষ্ঠা, ইবনে আসাকের, তারিখে দিমাশক ২৭ খণ্ড, ৪২৯ পৃষ্ঠা।) তার চরিত্রে এমন কোনো গুণ ছিল না, যা তাকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা দেয়। ইমাম জাহাবির মতো প্রখ্যাত ঐতিহাসিক তাকে ‘নাসেবি’ তথা আহলে বাইতবিদ্বেষী ও মদ্যপ বলে উল্লেখ করেছেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা)। বিবেকবান নেক্কার কোনো মানুষের পক্ষে এমন শাসককে কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। এমন শাসককে মেনে নেওয়ার অর্থই হলো ইসলামের মৌলিক আদর্শকে বিসর্জন দেওয়া। তাই মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র হিসেবে ইমাম হুসাইন (রা.) এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। শাসক হয়েই ইয়াজিদ তৎকালীন মদিনার গভর্নর ওয়ালিদ বিন উতবাকে চিঠি লিখে নির্দেশ দেন-যে কোনো মূল্যে যেন ইমাম হুসাইন (রা.)-এর কাছ থেকে বায়াত বা আনুগত্যের শপথ আদায় করা হয়। বায়াত আদায়ে অস্বীকৃতি জানালে তাঁর শির-েদ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়। ইমাম হুসাইন (রা.) স্পষ্ট বলে দেন, ‘আমার মতো লোক কখনো ইয়াজিদের মতো লোকের বায়াত গ্রহণ করতে পারে না।’ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ইয়াজিদের আনুগত্য স্বীকার করার অর্থ হলো জুলুম এবং ইসলামবিরোধী শাসনকে বৈধতা দেওয়া। তিনি মদিনা ছেড়ে মক্কার দিকে রওনা হন। এরপর কুফাবাসীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু পথিমধ্যে কারবালা নামক স্থানে ইয়াজিদের পাঠানো বিশাল সেনাবাহিনী তাঁকে ও তাঁর পরিবার এবং সঙ্গীদের অবরুদ্ধ করে। সেনাপতি ওমর ইবনে সাদ ও সিমার জিলজাউশানের নেতৃত্বে প্রায় ৩০ হাজার সৈন্যের বাহিনী ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দেয়। টানা তিন দিন ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শিবিরে নারী, পুরুষ এবং নিষ্পাপ শিশুরা পানির জন্য হাহাকার করতে থাকে। মহররমের দশম দিনে সংঘটিত হয় সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ড।
ইমাম হুসাইন (রা.)-এর ৭২ জন সঙ্গী, যাঁদের মধ্যে তাঁর পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন, বীরের মতো লড়াই করে একে একে শাহাদাতবরণ করেন। এমনকি ছয় মাসের শিশু আলী আসগর যখন পানির অভাবে ছটফট করছিল তখন তাকে দেখিয়ে পানি চাইলেও ইয়াজিদের পাষণ্ড বাহিনী তার গলায় তির নিক্ষেপ করে হত্যা করে। সবশেষে পিপাসার্ত ও ক্লান্ত ইমাম হুসাইন (রা.)-কে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁর শির-েদ করে বর্শার আগায় ইমামের মাথা মোবারক নিয়ে কুফা ও দামেস্কে প্রদর্শন করা হয় এবং তাঁর পবিত্র দেহকে ঘোড়ার খুরের নিচে পিষ্ট করা হয়। আহলে বাইতের নারীদের শৃঙ্খলিত করে দামেস্কে এজিদের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়। এ বর্বরতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
লেখক : প্রিন্সিপাল, আন-নূর মাদরাসা, বাসাবো, ঢাকা