ডেমোক্র্যাসি আর মবোক্র্যাসি কি একসঙ্গে থাকতে পারে? যদি বলি পারে না, সেটা হবে অর্ধসত্য। আবার যদি বলি পারে, তা-ও পুরো সত্য নয়। গণতন্ত্রের পাশে মবতন্ত্রের সহাবস্থান সহজ-সম্ভব, যদি তার সঙ্গী হয় হিপোক্র্যাসি। হিপোক্র্যাসি মানে ভণ্ডামি। এই জিনিস রপ্ত করতে পারলে ডেমোক্র্যাসির পাশে মবোক্র্যাসি, এমনকি অটোক্র্যাসিও দিব্যি চলতে পারে। আসলে সেটা শুধু সম্ভবই না, ইতিহাসে তা বহুবার প্রমাণিতও হয়েছে।
কথাটা শুনতে অতিশয়োক্তি মনে হলেও তার ঐতিহাসিক বাস্তবতা অনস্বীকার্য। মবতন্ত্র শুধু জনরোষের স্ফুলিঙ্গ না, কখনো কখনো তা ‘ন্যায়’রূপেও উপস্থিত হয়। ইতিহাসে এমন বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেখানে জনতার উচ্ছ্বাস, ক্ষোভ কিংবা আবেগকেই বিচারবিবেচনার বিকল্প হিসেবে কার্যত মেনে নেওয়া হয়েছে। আর সেই ‘বিচার’ কার্যকর হয়েছে জনতার হাতেই আইন নয়, যুক্তি নয়, বরং ক্ষোভ আর বিভ্রম দিয়ে।
১৭৯৩ সাল। ফরাসি বিপ্লবের উত্তাল সময়। জনগণের নামে, জনতার শত্রুদের শাস্তি দেওয়ার নামে শুরু হয় এক নতুন শাসনব্যবস্থা রেইন অব টেরর। এই সন্ত্রাসের রাজত্বের প্রধান কারিগর রোবেসপিয়র। গণতন্ত্রের কথা বলে আসা এই নেতা তখন ঘোষণা দেন ‘শান্তির কালে গণতন্ত্রের জন্য নৈতিকতাই যথেষ্ট, কিন্তু বিপ্লবের সময় দরকার নৈতিকতা ও সন্ত্রাস-দুটোই।’ তার মানে দাঁড়ায়, নৈতিক ভিত্তি থাকলে টেরোরিস্ট হতে কোনো বাধা নেই এবং বাস্তবে দেখা গেছে তারই প্রতিফলন।
সে সময় ফ্রান্সজুড়ে তথাকথিত আদালত বসত কখনো কোনো শহরের মহল্লায়, কখনো কোনো নিভৃত পল্লিতে। আদালতের চারপাশ ঘিরে রাখত বিক্ষুব্ধ জনতা। অভিযোগ উঠত, বিচার হতো, আর শাস্তি একটাই গিলোটিন। কোনো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই। কেউ হয়তো বিপ্লবী আদর্শের বিরোধিতা করেছে, হয়তো কোনো পক্ষই সরব ছিল না কিংবা শুধু ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ছিল তার মানেই সে ‘জনগণের শত্রু’। এটাই ছিল পিপলস জাস্টিসের বাস্তব চিত্র। বিচার হয়নি, চরিতার্থ করা হয়েছে প্রতিহিংসা।
সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, এই রেইন অব টেররের স্থপতি রোবেসপিয়র নিজেও শেষ পর্যন্ত গিলোটিনের নিচে জীবন দিয়েছেন। জনতার আদালত, যে আদালত তিনি নিজে বানিয়েছিলেন, সেই আদালতই তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। ইতিহাসে একে বলে ক্রিয়েটরের গিলোটিন নিজের ফাঁদে নিজে পড়া।
এই জায়গায় এসে যায় আরেক ‘দৈত্যের’ গল্প। ১৮১৮ সালে প্রকাশিত মেরি শেলির লেখা উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’। তরুণ বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গবেষণাগারে তৈরি করেন এক কৃত্রিম মানব। এর অবয়ব বিকৃত ভয়াল দর্শন। ওকে দেখলে ভয় ও ঘৃণায় মানুষ দূরে সরে যায়। অবশেষে বিজ্ঞানী নিজেও এই কিম্ভূতকিমাকারের আচার-আচরণে বিরক্ত। তাকে তিনি ত্যাগ করেন। এরকম অবহেলার শিকার হয়ে সেই দৈত্য-মানব একদিন রেগেমেগে তারই মনিবকে হত্যা করে। এই কাহিনি নিছক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি নয়; এটি প্রতীক, একটি রূপক যে দৈত্য আমরা তৈরি করি, একদিন সেটাই আমাদের গিলে খায়।
রোবেসপিয়র যেমন ‘জনতার ন্যায়ের’ নামে এক ভয়াবহ সামাজিক যন্ত্র তৈরি করেছিলেন, যেটি শেষ পর্যন্ত তাকেই গ্রাস করেছিল তেমনি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্যও তার নির্মাতাকে শেষ করেছে।
দুটোই হয়ে উঠেছে প্রতীক : যখন কোনো শক্তি বা ন্যায়বোধ জনতার অন্ধ আবেগে রূপান্তরিত হয়, তখন তা আর ন্যায় থাকে না তা হয়ে ওঠে প্রতিহিংসার হাতিয়ার।
আজকের দিনেও কি দেশে ও বিদেশে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে? আমরা এখনো ‘গণআদালত’, ‘গণপিটুনি’, বিক্ষুব্ধ জনতার বিচার মব জাস্টিস-এই শব্দবন্ধগুলো শুনতে পাই। এসব শুনে কেউ কেউ বিচলিতবোধ করেন, আবার অনেকে বলেন উচিত কাজ হয়েছে; যদিও উচিত-অনুচিতের বিচারবোধ তাদের ঠিকমতো কাজ করে কি না, সন্দেহ। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার রয়েছে। নাগরিক হিসেবে সুরক্ষা লাভের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। কিন্তু মব তা বিলক্ষণ পারে, বিশেষত সেসব দেশে যেখানে ডেমোক্র্যাসির সাথি হিপোক্র্যাসি কিংবা অটোক্র্যাসি। মব ত্রাসের অজস্র উদাহরণ রয়েছে প্রাচ্য ও প্রাতীচ্যের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কারা এই ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা?’ যারা মারছে? নাকি যারা মবকাণ্ড উসকে দিচ্ছে? আমরা মবরূপে যাদের দেখি, তাদের হাতে বাঁশের লাঠি, ইটপাটকেল, আজকাল আবার নতুন অস্ত্র এসেছে জুতো ও ডিম। আমরা স্কুলের ছেলেমেয়েদের টিচারদের ওপর মব করতে দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে চুরির অভিযোগ তুলে এক অসহায় মানসিক প্রতিবন্ধীর হত্যাকাণ্ডের খবরও আমরা জানি। এর আগে ২০১৯ সালে বাড্ডায় ছেলেধরা অপবাদ দিয়ে রেনু নামের এক জননীকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। প্রতিবেশী দেশ ভারতে মোদি-জমানায় সাম্প্রদায়িককাণ্ডে বহু মানুষকে পিটিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসনামলে মব পাঠিয়ে বিরোধী দলের বহু নেতা-কর্মীর বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। তাদের এলাকা ছাড়া করা হয়েছে। ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবির বলে কতজনকে মেরে তক্তা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারও ইয়ত্তা নেই। এরশাদের সময়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও গণধোলাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল। একজন প্রবীণ রাজনীতিককে লাঞ্ছিত করার পর দিগম্বর করে পথে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়েছিলেন। আর এখন আরেক রকমভাবে মব করা হচ্ছে। এগুলো সবারই জানা।
প্রশ্ন হচ্ছে, যাদের আমরা মব বলি তারাই কি সব? তারাই কি ক্ষমতার কেন্দ্র? নাকি তারা রিমোট কন্ট্রোলড পুতুল? মব জাস্টিসের ভয়াবহতা কেবল উচ্ছৃঙ্খল জনতার নয়। বরং আসল দায় তাদের, যারা আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়। যাদের মুখে তত্ত্ব, কথায় ধর্ম, বুকে নেতৃত্বের মিথ, আর মাথায় অজস্র জনতাকে চালানোর নকশা। তারা কখনো ‘নেতা’, কখনো ‘ধার্মিক’, কখনো ‘আদর্শবাদী’ কখনো অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, কখনো বা ‘গডফাদার’। তবে তাদের কখনোই মবের মাঝে দেখা যায় না, কিন্তু মব যারা করে তাদের ওপরে তারা থাকে অদৃশ্যশক্তির ছায়া হয়ে। কী নাম দেব আমরা সেই অদৃশ্যশক্তির?
তাই মব জাস্টিসকে শুধুই ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতার কাজ’ বললে ভুল হবে। বরং বলতে হবে-এটি একটি অরগানাইজড ও পরিকল্পিত প্রক্রিয়া, যার দায়ভাগ বহুস্তরে বিন্যস্ত। একদল মানুষ ঘটনার আয়োজক, একদল প্ররোচক, আরেক দল ঘটনা ঘটায়। সেই অদৃশ্যশক্তি, কে জানে, হয়তো আইনকেও ডমিনেট করে। আর তখন তৈরি হয় অভিনয়ের নানান দৃশ্যপট।
মবোক্র্যাসি, রোবেসপিয়রের পিপলস জাস্টিস, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্য-এই তিনটি রূপক আমাদের এক জায়গায় এনে দাঁড় করায় : যে শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ ছাড়া উন্মুক্ত করা হয়, সেটাই একদিন সব নিয়ন্ত্রণ আলগা করে দেয়।
উপসংহারে বলার কথা এই যে ডেমোক্র্যাসি, তা বাস্তবায়নের যে পর্যায়েই থাকুক না কেন, মবোক্র্যাসি তার সাথি হতে পারে না। কেননা মবোক্র্যাসি ভয় উৎপাদন করে, মানুষের জীবন ও সম্মানকে ধূলিসাৎ করে। সে আইনের তোয়াক্কা করে না।
পক্ষান্তরে গণতন্ত্র সাধারণ মানুষের ভয়ের কারণগুলো নির্মূল করে, সমুন্নত করে আইনের শাসন ও মানুষের মর্যাদা। সুরক্ষিত করে মানবিক অধিকার। আর আইন গণতন্ত্রকে সংহত ও সুরক্ষিত করে। গণতন্ত্রে ভণ্ডামির কোনো জায়গা নেই।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক