সমাজ সংস্কার একটি সুন্দর-মনোরম স্বপ্ন, মানুষের হৃদয়ের সুদীর্ঘ-গভীর আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। এই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয় যখন মানবতার সর্বোচ্চ গুণাবলি- খোদাভীতি, প্রেম-ভালোবাসা, ত্যাগ-কোরবানি, নীতি-নৈতিকতা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও প্রশংসার অনুভূতি জীবনের প্রতিটি গতিপথকে আলোকিত করে। হজরত আবুজর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বলেছেন, তুমি যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় কর, পাপ করলে সঙ্গে সঙ্গে পুণ্যও কর; যাতে পাপ মোচন হয়ে যায় এবং মানুষের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার কর (মুসনাদে আহমাদ-২১৩৫৪, তিরমিজি-১৯৮৭)। একটি বাগান যেমন ফুলের রং ও মনোরম-মিষ্টি গন্ধে সুরভিত হয়, তেমনি সামাজিক সৌন্দর্য প্রতিটি ব্যক্তির সদাচার, চরিত্রের বিশুদ্ধতা ও অন্যদের প্রতি সদিচ্ছার মধ্যে লুকিয়ে থাকে। সমাজ সংস্কারের প্রথম ধাপ হলো প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সংস্কার। যখন প্রতিটি মানুষ তার হৃদয় ও মনকে সদাচার, ন্যায়-বিশ্বস্ততা ও সততার অলংকার দিয়ে সজ্জিত করবে, তখনই সামাজিক সংস্কার-সৌন্দর্যে সে অবদান-ভূমিকা রাখল। প্রতিটি ফোঁটা যেমন সমুদ্রের গভীরতা ও প্রস্থ বৃদ্ধি করে, তেমনি প্রতিটি ব্যক্তির সদাচার ও নৈতিকতা সামাজিক সংস্কারের ভিত্তিকে শক্তিশালী করে। সামাজিক সৌন্দর্যের সূত্রপাত হয় সততা-নৈতিকতা, প্রেম-ভালোবাসা ও সহনশীলতা থেকে। যখন আমাদের হৃদয়ে অন্যদের প্রতি সদিচ্ছার অনুভূতি থাকে, ইখলাস-আন্তরিকতা ও ভদ্রতা গড়ে ওঠে, তখন সমাজ সুকৃতি-সৌন্দর্যের জীবন্ত উদাহরণ হয়ে ওঠে। হাদিস শরিফে এসেছে হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত; রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের কেউ প্রকৃত ইমানদার হতে পারবে না; যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে (বুখারি শরিফ-১৩, মুসলিম শরিফ-৪৫, ইবনে হিব্বান-২৩৫)।
সমদর্শিতা-ন্যায়বিচার, সহনশীলতা ও সাম্যের নীতি মরূদ্যানের শীতল ছায়ার মতো সামাজিক সম্পর্ককে শক্তিশালী ও সতেজ করে। ইখলাস-আন্তরিকতা ও ত্যাগ-কোরবানি হলো সামাজিক অগ্রগতির সবচেয়ে সুন্দর ভিত। যখন একজন ব্যক্তি অন্যের উন্নতি-সমৃদ্ধি ও সফলতাকে নিজের জীবনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে, তখন কেবল তার নিজের হৃদয়ই নয়, সমাজও সুখের সুবাসে ভরে ওঠে। হজরত আবু রুকাইয়াহ তামিম বিন আওস দারি (রা.) থেকে বর্ণিত; রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কল্যাণ কামনা করার নামই দীন। আমরা জিজ্ঞেস করলাম কার জন্য?’ তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রসুলের জন্য, মুসলিম শাসকদের জন্য ও মুসলিম জনসাধারণের জন্য (মুসলিম শরিফ-২০৫)। কল্যাণ কামনা মানুষের মহান মূল্যবোধ ও প্রেম-ভালোবাসা থেকে উৎপাদিত চিরন্তন সুবাস, এর প্রতিটি কোণে মানবতার মহত্ত্বের গান প্রতিধ্বনিত হয়। যখন মানুষ তার জীবনকে অন্যদের জন্য আলো ও আশার উৎস করে তোলে, তখন সামাজিক পরিপূর্ণতা অর্জন হয়। যখন হৃদয়ে মহান আল্লাহর ভয় ও মানবজাতির প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা জন্মায়, তখন সমাজ একটি উজ্জ্বল আয়না হয়ে ওঠে, যেখানে বিশ্ব সৌন্দর্য-সুকৃতির প্রতিফলন দেখে।
যদি প্রতিটি ব্যক্তির চিন্তাভাবনা, ক্রিয়াকর্ম ও আবেগে সদাসর্বদা ইখলাস-আন্তরিকতা বিরাজ করে, তাহলে সামাজিক সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। সমাজ সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো প্রত্যেক ব্যক্তি-বস্তুকে তাদের স্বস্থান ও পদে রাখা। রসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের মূল্য বুঝতেন এবং প্রতিটি ব্যক্তির সঙ্গে তার যথাযথ মর্যাদা অনুযায়ী আচরণ করতেন। এটি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্তর্দৃষ্টি ও নৈতিক আচরণ। এই মহৎ গুণাবলি তিনি আমাদের ও তাঁর সাহাবিদের কথা ও কাজের মাধ্যমে শিখিয়েছেন। হাদিস শরিফে এসেছে হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : ‘রসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের মানুষের সঙ্গে তাদের যথাযথ স্থান-মর্যাদা অনুসারে আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন’ (আবু দাউদ-৪৮৪২)।
রসুলুল্লাহ (সা.) এই হাদিসে মানুষকে তাদের মূল্যবোধ, পদমর্যাদা ও অবস্থান বিবেচনা করে সংগতিপূর্ণ আচার-আচরণের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন। প্রকৃত মুমিন মানুষের সঙ্গে তাদের যথাযথ মর্যাদা অনুসারে আচরণ করবে, মানসম্মান ও প্রশংসার ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে সমান আচরণ করবে না, বরং ধর্মীয় পদমর্যাদা, বয়সের দিক থেকে পদমর্যাদা ও আমল-কর্তব্যপরায়ণতার দিক থেকে পদমর্যাদা অনুসারে আচরণ করবে। আরবি একটি প্রবাদ আছে : যার অর্থ হলো সবকিছুকে তার সঠিক স্থানে না রাখা অন্যায়। রসুলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অবস্থান-মর্যাদা অনুসারে সম্মান করতে এবং সবকিছুকে তার স্বস্থানে রাখতে আমাদের শিখিয়েছেন। সমাজ সংস্কারের যাত্রা অবশ্যই সুদীর্ঘ ও আকর্ষণীয়। এই যাত্রার পথগুলো অমূল্য, প্রতিটি পদক্ষেপ প্রেম-ভালোবাসা, নীতি-নৈতিকতা ও ভ্রাতৃত্বের উজ্জ্বল প্রদীপ দ্বারা আলোকিত।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, মদিনাতুল উলুম মাদরাসা, বসুন্ধরা, ঢাকা