বাংলাদেশে মানবসভ্যতার বিকাশ কোথায় ঘটেছিল-তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। এ বিতর্কের শক্ত অবস্থান রয়েছে ঐতিহ্যবাহী জনপদ নরসিংদীর। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, শহীদ আসাদ, ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন, কবি শামসুর রাহমান, চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদসহ অনেক কৃতিপুরুষের স্মৃতিমণ্ডিত এই জনপদের রয়েছে গর্ব করার মতো ঐতিহ্য। আড়াই হাজার বছর আগেও নরসিংদীতে সমৃদ্ধ নগর-রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল। এই জনপদের উয়ারী-বটেশ্বরের সঙ্গে সেই প্রাচীন যুগেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং রোমান সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ছিল। খ্যাতনামা গবেষক ও কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান আর্কিওলজি বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী এ তথ্য জানিয়েছেন। আর অস্ট্রেলিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইউরোপীয় প্রাগৈতিহাস গবেষক গর্ডন চাইল্ডের অভিমত, নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর এলাকাটি দ্বিতীয় শতকের ভূগোলবিদ টলেমি উল্লেখিত সমৃদ্ধ জনপদ সোনাগড়া। উয়ারী-বটেশ্বরে পাওয়া গেছে আড়াই হাজার বছর আগে ব্যবহৃত মুদ্রা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেখানে শুধু নগরায়ণই নয়, নদীবন্দর ও বাণিজ্যনগরও গড়ে উঠেছিল।
নরসিংদীর বেলাব উপজেলা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পশ্চিমে উয়ারী এবং বটেশ্বর গ্রামের অবস্থান। মধুপুর গড়ের পূর্ব সীমান্তের ওই দুই গ্রামে অনুসন্ধান ও প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আবিষ্কৃত হয়েছে আড়াই হাজার বছর আগের প্রাচীন দুর্গ নগর। আজ থেকে ৯ দশক আগে ১৯৩০-এর দশকে মুহম্মদ হানিফ পাঠান নামের এক স্কুলশিক্ষক উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে তুলে ধরেন। বাবার পথ ধরে তাঁর পুত্র মুহম্মদ হাবিবুল্লাহ পাঠান উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নবস্তু সংগ্রহ ও গবেষণায় নিজেকে জড়িত করেন। তাঁর গবেষণা এবং দেনদরবারে কাজ হয়। ১৯৯৬ সাল থেকে উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের কাজ চলে। ২০০০ সালে শুরু হয় উয়ারী-বটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের কাজ। গ্রাম দুটিতে কৃষকের জমি চাষ, নালা কাটা, পাতকুয়া তৈরি ও মাটি কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণের সময় অনেক প্রত্নবস্তু উন্মোচিত হয়। পাওয়া যায় নানা ধরনের বিচিত্র ও মূল্যবান পাথর এবং কাচের পুঁতি এমনকি রৌপ্য মুদ্রা।
আবিষ্কৃত হয়েছে ৬০০ মি. দৈর্ঘ্য ৬০০ মি. প্রস্থ আয়তনের চারটি মাটির দুর্গ-প্রাচীর। দুর্গ প্রাচীরের ৫-৭ ফুট উঁচু ধ্বংসপ্রাপ্ত কিছু অংশ এখনো টিকে আছে। আবিষ্কৃত দুর্গের চারদিকে রয়েছে পরিখা। যেমন প্রাচীন ও মধ্যযুগের নগরের চারদিকে পরিখা খনন করা হতো নিরাপত্তাবলয় হিসেবে। কালের ব্যবধানে এসব পরিখা মাটি ভরাট হয়ে গেলেও পূর্ব প্রান্তের পরিখার চিহ্ন আড়াই হাজার বছর পরও দৃশ্যমান। দুর্গের পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রায় ৫ দশমিক ৮ কি.মি. দীর্ঘ, ২০ মি. প্রশস্ত ও ১০ মি. উঁচু অসম রাজার গড় নামে একটি মাটির বাঁধ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এটি দ্বিতীয় দুর্গ প্রাচীর হিসেবে উয়ারী দুর্গনগরের প্রতিরক্ষার কাজ করত।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী উয়ারী দুর্গনগরের বাইরে আরও ৫০টি প্রত্নস্থান এ যাবৎ আবিষ্কৃত হয়েছে। আমাদের এই দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে দুর্গ আকারে গড়ে তোলা হতো নগর রাষ্ট্র। খ্রিস্টপূর্ব দুই শতাব্দী আগের মৌর্য যুগের সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গুরু ও পরামর্শক চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে দুর্গকে নগর বলা হয়েছে। ১১ শতকের পণ্ডিত কৈয়টের মতে, ‘নগর হলো উঁচু পাঁচিল এবং পরিখা দিয়ে ঘেরা বাসভূমি, যেখানে কারিগর ও ব্যবসায়ী সংঘের তৈরি আইন ও নিয়মকানুন বলবৎ থাকত।’ গ্রামীণ এলাকায় নগরায়ণের ক্ষেত্রে যে দশটি নিয়ামকের তথ্য গর্ডন চাইল্ড ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতেও একই মত সমর্থন করে। উয়ারী-বটেশ্বর ছিল এই প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা একটি দুর্গ নগর, নগর বা একটি নগর কেন্দ্র। আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তু বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায় যে উয়ারী-বটেশ্বর ছিল একাধারে একটি নগর ও সমৃদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র। এমনকি এটি নগর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে এমন ধারণাও পোষণ করেন ইতিহাস গবেষকরা।
শুধু উয়ারী-বটেশ্বর নয়, ধারেকাছের গ্রাম রাঙ্গারটেক, সোনারুতলা, কেন্দুয়া, মরজাল, চণ্ডীপাড়া, পাটুলি, জয়মঙ্গল, হরিসাঙ্গন, যশোর, কুণ্ডাপাড়া, গোদাশিয়া এবং আবদুল্লাহ নগরেও প্রাচীন বসতির চিহ্ন উদঘাটিত হয়েছে। উয়ারী-বটেশ্বর নগর রাষ্ট্রের পার্শ্ববর্তী এলাকার অধিবাসীরা ছিল কৃষিজীবী। তাদের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত ফসল নগরে বসবাসরত ধনিক, বণিক, পুরোহিত, কারিগর ও রাজকর্মচারীদের চাহিদা পূরণ করত। উয়ারী-বটেশ্বরের অধিবাসীরা উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে যে পরিচিত ছিল তা সহজেই অনুমেয়। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগেই তারা ধাতু গলিয়ে মুদ্রা তৈরি করার প্রযুক্তি আয়ত্তে আনতে সক্ষম হয়েছিল। পুঁতির সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে অলংকার তৈরি করত উয়ারী-বটেশ্বর নগর রাষ্ট্রের কারিগররা। দক্ষিণ নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী জনপদ মাধবদী-বাবুরহাট। সেই মোগল আমলেও এ অঞ্চলের তাঁতিদের সুনাম ছিল ভারতবর্ষজুড়ে। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি হতো বাবুরহাট-মাধবদীর তাঁতের কাপড়। ঢাকাইয়া মসলিন নামের যে মিহি কাপড় সারা দুনিয়ায় বিস্ময় বলে বিবেচিত হতো, তাও উৎপাদিত হতো মাধবদী-বাবুরহাটে।
ব্রিটিশ আমলে নরসিংদীর মাধবদী-বাবুরহাটে তাঁতিদের ওপর নেমে আসে মরণ আঘাত। বিলাতে উৎপাদিত মিলের কাপড় তাঁতের কাপড়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায়। শোনা যায়, মসলিন উৎপাদনকারী তাঁতিদের ধরে ইংরেজ বেনিয়ারা আঙুল কেটে দেয়। এত কিছুর পরও মাধবদী-বাবুরহাটের তন্তুবায়ীরা পিছু হটেনি। তারা মাটি কামড়ে টিকে ছিল তাদের পেশায়। এই একাগ্রতারই শেষ পর্যন্ত জয় হয়। দেশের বস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছে মাধবদী-বাবুরহাট একটি অপরিহার্য নাম। অনেকের মতে, মাধবদী-বাবুরহাট হলো দেশের বস্ত্রশিল্পের রাজধানী। এই এলাকাটি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সারা দেশের বস্ত্র ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু। গত তিন যুগে মাধবদী-বাবুরহাট এলাকায় ঘটেছে দ্রুত শিল্পায়ন। এ শিল্পায়ন ভারতীয় শাড়ি, লুঙ্গি ও কাপড়ের আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষা করেছে। ক্রেতারা এখন ভারতীয় প্রিন্টের বদলে উন্নত মানের বাংলাদেশি ছাপার শাড়ি বেছে নিচ্ছে। একসময় ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে শাড়ির পাশাপাশি আসত বেডসিট। এখন মাধবদী ও সংলগ্ন এলাকায় যেসব বেডসিট তৈরি হচ্ছে, তা শুধু ভারত নয়, যে কোনো দেশের পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার যোগ্যতা রাখে। বলা হয়, অর্থনীতি হলো রাজনীতির প্রাণ। মাধবদী-বাবুরহাটের রাজনীতির দিকে তাকালে সে সত্যটি স্পষ্ট হয়ে পড়ে। এ এলাকার রাজনীতিকরা জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও চেহারাটা ভিন্ন। মাধবদী-বাবুরহাটের নেতা-কর্মীরা এলাকাবাসীর অর্থনৈতিক অস্তিত্বকে রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে জিম্মি হতে দেননি।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও নরসিংদী ছিল নারায়ণগঞ্জের একটি থানা। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৭ সালে এটি মহকুমায় উন্নীত হয়। ১৯৮৪ সালে জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নরসিংদী। মুক্তিযুদ্ধে নরসিংদীর বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল মুক্ত। এখানকার বিপুলসংখ্যক মানুষ যোগ দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। যাঁদের সিংহ ভাগ ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অনুসারী। সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসার মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা তাঁদের উদ্বুদ্ধ করেছিল।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের খালকাটা কর্মসূচিতে জড়িয়ে আছে নরসিংদীর নাম। স্বাধীনতার ঘোষক বীর উত্তম জিয়াউর রহমান খালকাটা কর্মসূচিতে অংশ নেন ১৯৭৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। বর্তমানে মহিষাশুড়া ইউনিয়নের আবদুল্লাহ বাজার যেখানে, সেখানে এসে হাজির হন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ ছোটবড় সবাইকে নিয়ে রাস্তা উদ্বোধন করেন তিনি। তারপর বালুসাইর হয়ে মহিষাশুড়ার বর্তমান স্লুইস গেট বাজার এলাকায় এসে বানিয়ার খালকাটা কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। বাজারের পূর্ব পাশের মাঠে বিশাল জনসমুদ্রে বক্তব্য দেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। শহীদ জিয়ার খালকাটা কর্মসূচির কথা ৪৭ বছর পরও মনে রেখেছে এলাকার মানুষ। তাঁদেরই একজন মহিষাশুড়ার সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেন তপু বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জিয়া সেদিন আমাদের মন জয় করেছিলেন কাজ দিয়ে। নরসিংদীবাসীর হৃদয়রাজ্যে তিনি ঠাঁই করে নিয়েছিলেন কী এক জাদুবলে। যার কোনো তুলনাই নেই।
লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসুর সাবেক জিএস