মুনাফিক একটি বহুল প্রচলিত আরবি শব্দ। বাংলাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এ শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। মুনাফিক অর্থ দ্বিমুখী নীতিওয়ালা অসৎ মানুষ। যারা পরিবার, সমাজ এবং দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর। নৈতিকতা বিবর্জিত মুনাফিকরা মানুষের কাছে দুই রকম কথা বলে বেড়ায়। ভুল বোঝাবুঝি এবং অনৈক্যে ইন্ধন জুগিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে অশান্তি সৃষ্টি করে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, মুনাফিক হচ্ছে তারা যখন ইমানদারদের সঙ্গে মিলিত হয় তখন বলে আমরা ইমান এনেছি, আবার যখন শয়তানের সঙ্গে মিলিত হয় তখন বলে আমরা অবশ্যই তোমাদের সঙ্গে আছি। আমরা ইমানদারদের সঙ্গে শুধু ঠাট্টা করি মাত্র। (সুরা বাকারা : ১৪)।
মুনাফিকদের দেখে বুঝে ওঠা কঠিন। দৃশ্যত তাদের আচার-আচরণ মুসলিমের মতো। তারা মসজিদে যায়, সালাতও আদায় করে এবং অন্য মুমিনের সঙ্গে দৃশ্যত ভালো সম্পর্ক রাখে; কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তারা কথা এবং কাজের মধ্য দিয়ে সমাজে বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, যার মধ্যে চারটি স্বভাব বিদ্যমান থাকবে সে মুনাফিক। সাহাবিরা জানতে চাইলেন সেগুলো কী? তিনি বললেন, যে মিথ্যা কথা বলে, ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে, চুক্তি করলে তা লঙ্ঘন করে, আর যখন ঝগড়া করে তখন অশ্লীল কথা বলে। (বুখারি শরিফ : ২৪৫৯)।
মুমিনদের তাই মুনাফিকদের সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকতে হবে। মুনাফিকরা মুখে ইসলামের কথা বলে; কিন্তু তারা সত্যিকার অর্থে ইসলামকে ভালোবাসে না। বাস্তবে তারা মিথ্যাবাদী। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুনাফিকরা যখন তোমার কাছে আসে তখন তারা বলে হে মুহাম্মদ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি তুমি অবশ্যই আল্লাহর রসুল। হ্যাঁ, আল্লাহতায়ালাও জানেন তুমি নিঃসন্দেহে তাঁর রসুল। কিন্তু আল্লাহতায়ালা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। (সুরা মুনাফিকুন : ১)।’ মুনাফিক চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য মিথ্যাবাদিতা। যে মিথ্যাবাদিতা সব পাপের ভিত্তিমূল। নিজেদের মুসলমান হিসেবে দাবি করতে হলে মিথ্যা থেকে অবশ্যই আমাদের দূরে থাকতে হবে। রসুল (সা.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তির জন্য মিথ্যাবাদী হওয়া এতটুকুই যথেষ্ট, সে যা শোনে তা সবার কাছে প্রচার করে বেড়ায়। (মুসলিম শরিফ : ৫)। সোজা কথায় যাচাই না করে শোনা কথা প্রচার করাও মিথ্যাবাদিতার শামিল।
মুনাফিকের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য- অঙ্গীকার বা ওয়াদা ভঙ্গ করা। সমাজের সর্বস্তরে এ ধরনের লোকের অভাব নেই। সমাজপতি থেকে শুরু করে সমাজের সবচেয়ে নিচু স্তর পর্যন্ত ওয়াদা বরখেলাপকারীরা বিদ্যমান। সমাজবদ্ধ মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে কখনো কখনো একে অপরের কাছ থেকে টাকা ধার নেন। এ ক্ষেত্রে পাওনাদারের অর্থ ওয়াদা অনুযায়ী পরিশোধ করা কর্তব্য। তার বদলে পাওনাদারকে হেনস্তা করা মুনাফেকির লক্ষণ। একজন মুমিন মুসলমান কখনো এ ধরনের কাজ করতে পারে না।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য- আমানতের খেয়ানত করা। আমরা প্রতিনিয়ত এ ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই। কারও কাছে কোনো সম্পদ, অর্থ বা সোনা-রুপা অর্থাৎ কোনো মূল্যবানসামগ্রী জমা রাখলে আমানতকারী তা ফিরিয়ে দিতে টালবাহানা করে কিংবা তা দেয় না। যাকে বলা হয় আমানতের খেয়ানত। এ বৈশিষ্ট্য যার মধ্যে বিদ্যমান সে মুনাফিক। সুরা নিসায় আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত তাঁর হকদারদের কাছে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সুরা নিসা : ৫৮)।
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য- মুনাফিক অশ্লীল বা অশালীন কথা বলে। কখনো একজন মুমিন কোনো অবস্থাতেই অশালীন ভাষা ব্যবহার করেন না। আর মুনাফিক কখনো মতের অমিল হলেই অশালীন ভাষায় কথা বলে। সমাজে অশ্লীলতার প্রসার ঘটায়।
আল্লাহ বলেন, যারা চায় দুনিয়ার বুকে অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক, তারা দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তি ভোগ করবে। (সুরা নুর, ২৯)। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা ছিল মদিনার নেতৃস্থানীয় লোক। এদের চালচলন আর কথাবার্তায় ছিল আভিজাত্যের ছাপ। এরা যখন মুসলমানদের সঙ্গে কথা বলতে আসত তখন চাকচিক্যময় পোশাক পরত। এদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তুমি যখন এদের প্রতি তাকিয়ে দেখ, তখন তাদের দেহাবয়ব তোমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় মনে হয়। আর এরা যখন কথা বলে তখন তাদের কথা তোমার শুনতেই ইচ্ছা করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরা দেয়ালের গায়ে খাড়া করে রাখা কাঠের গুঁড়ির মতো। (সুরা মুনাফিকুন, ৪)।
আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে মুনাফেকির হাত থেকে রক্ষা করুন।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক