একটি জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে বড় বাধা দুর্নীতি। দুর্নীতি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই বয়ে আনে না বরং রাষ্ট্রের নৈতিক কাঠামোও ভেঙে দেয়। ইসলাম এমন এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র-তিন স্তরেই ন্যায়ের চর্চা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে গুরুত্ব দিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে সব সময় আলেম সমাজ অগ্রগামী ছিল। নিকট অতীত এবং বর্তমানেও আলেম সমাজ-পীর মাশায়েখরা দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে দুর্নীতি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কর না এবং বিচারকের কাছে তা উপস্থাপন কর না, যাতে অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করতে পার (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৮)।’ রসুল (সা.) বলেন, ‘ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহণকারী উভয়েই জাহান্নামের আগুনে থাকবে (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩৫৮০)।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম (বুখারি, হাদিস, ৬৭৮৮)।’ আরেক হাদিসে তিনি বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে (বুখারি, হাদিস ৮৯৩)।’ ‘যে ব্যক্তি আমাদের মধ্যে কোনো দায়িত্বে নিযুক্ত হয়ে কিছু গোপন রাখবে, সে কিয়ামতের দিন চোর হিসেবে উঠবে (বুখারি, হাদিস ৭১৭৪)।’ এ হাদিস ও আয়াতগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দুর্নীতি কেবল একটি দুনিয়াবি অন্যায় নয়, বরং আখিরাতের ভয়াবহ শাস্তিরও কারণ। ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাই, ওলামায়ে কেরাম শুধু ইবাদত-বন্দেগিতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির দুর্নীতির বিরুদ্ধেও ছিলেন সোচ্চার ইমাম আবু হানিফা (রহ.) খলিফা মনসুরের বিচারপতির পদ প্রত্যাখ্যান করেন। শাসকের দুর্নীতিপূর্ণ সিদ্ধান্তে সায় না দেওয়ায় তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত কারাগারেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) ‘কোরআন সৃষ্ট’ মতবাদে খলিফার চাপ উপেক্ষা করে সত্যের ওপর অটল ছিলেন। কঠোর নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি বাতিলের সঙ্গে আপস করেননি। ইমাম মালেক (রহ.) জনগণকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে উৎসাহিত করেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) রাজনৈতিক ও সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে কলম ও কথার মাধ্যমে লড়াই চালিয়ে গেছেন।
একইভাবে দুর্নীতি-অন্যায় প্রতিরোধে ভারতীয় উপমহাদেশে ওলামায়ে কেরামের অবদানও স্মরণীয়। শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ ও শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে কলম ধরে এবং সরাসরি জেহাদ করে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে সংস্কারের ডাক দেন। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, হুসাইন আহমদ মাদানী ও শিবলী নোমানী (রহ.) ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং জনগণকে নৈতিকতার শিক্ষা দিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখেন। আল্লামা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে জাতিকে গড়ে তুলেছেন নৈতিক ও আদর্শের সৈনিক হিসেবে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি এক ভয়াবহ রূপ নেয়। তখনো আলেম সমাজ জনগণকে সচেতন করেছেন বিভিন্নভাবে ওয়াজ-মাহফিলে। তারা বারবার সতর্ক করে বলেন, হালাল উপার্জন ছাড়া কোনো ইবাদত কবুল হয় না। যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, সে মুসলমানদের দলভুক্ত নয়। সৎ উপার্জনকারীর রিজিকে আল্লাহ অভাবনীয় বরকত দেন। এমনিভাবে কোরআন-সুন্নার সার নির্যাস মানুষের সামনে তুলে ধরে মানুষকে অন্যায়-দুর্নীতিতে থেকে ফিরিয়ে রাখার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন।
বর্তমান সময়ের ওলামায়ে কেরামকেও সমাজ সংস্কারে ভূমিকা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ওলামায়ে কেরামের করণীয় হলো ইসলামি শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী চেতনা গঠন করা। জুমার খুতবা ও মসজিদভিত্তিক আলোচনা-মাহফিল করে সর্বস্তরে দুর্নীতির দুনিয়া-আখেরাতের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা। সমাজ ও রাষ্ট্রে যারা নেতৃত্ব দেন তাদের মাঝে নৈতিকতা বৃদ্ধি করা। প্রয়োজনে ভালো আলেমদের রাজনীতির ময়দানে এগিয়ে আসা।
পরিশেষে বলতে চাই, একটি আদর্শ রাষ্ট্র বড় বড় অবকাঠামো নয় বরং নৈতিক মূল্যবোধের ওপর টিকে থাকে। তাই আমাদের নৈতিক উন্নতির দিকে সব সময় নজর রাখতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে ওলামায়ে কেরামের জ্ঞান, চিন্তা ও নেতৃত্ব প্রয়োজন আজ। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি তারা যদি সমাজের প্রতিটি স্তরে নৈতিকতার আলো ছড়িয়ে দেন, তাহলে ইনশাআল্লাহ আমরা একদিন গড়ে তুলতে পারব দুর্নীতিমুক্ত এক কল্যাণ রাষ্ট্র। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রিন্সিপাল চরপাথালিয়া সালমান ফারসী (রা.) মাদরাসা, গজারিয়া, মুন্সিগঞ্জ
