আমরা সবাই আল্লাহকে পেতে চাই। ভালো মানুষ হতে চাই। আল্লাহর অলি হয়ে আল্লাহর হতে চাই। চাই দুনিয়া-আখেরাত ফুলে ফুলে সাজিয়ে তুলতে। কীভাবে অলি হওয়া যায় আমরা অনেকেই জানি না। জানি না বলেই ভুল পথে অনেক দূর চলে যাই। কখনো কখনো এত দূর চলে যাই যে পেছনে আর ফেরা হয় না বা ফেরার সুযোগ পাই না। তবে আল্লাহ যাদের সহায় হন তারা ভুলের পথে বেশি দূর এগোয় না। আবার কেউ কেউ অনেক দূর যাওয়ার পরও আল্লাহর মায়াবি হাতছানি তাদের ফিরিয়ে আনে মূলের কাছে। কোরআনের কাছে। ইসলামের কাছে। তারাই আল্লাহর অলি। আল্লাহর প্রিয়। আল্লাহও তাদের কাছে প্রিয়তম হয়ে ওঠেন।
কীভাবে আল্লাহর অলি হওয়া যায় এ নিয়ে অনেক জটিল ও বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায় সুফিদের গ্রন্থে। সহজে আল্লাহর অলি হওয়ার আলোচনা খুব কমসংখ্যকই সুফির লেখাতেই পাওয়া যায়। হুজ্জাতুলইসলাম ইমাম গাজ্জালি (রহ.)-এর এক ছাত্র তাঁর কাছে জানতে চেয়েছেন অলি হওয়ার সহজ পথ সম্পর্কে। জবাবে ইমাম গাজ্জালি চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। যা তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর ‘আর রিসালাহ’ নামক পুস্তিকায়। ইমাম গাজ্জালি লেখেন- ‘প্রিয় ছাত্র আমার! তুমি জানতে চেয়েছ কীভাবে আত্মশুদ্ধি করে আল্লাহকে পাওয়া যায়, তা বলার জন্য। এ বিষয়ে আমার এহইয়াউল উলুমুদ্দিনসহ অন্যান্য গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তবে তুমি যদি সহজে অলি হতে চাও তোমাকে চারটি বিষয় অর্জন করতে হবে। প্রথম বিষয় হলো, বিদাতমুক্ত আকিদা। আমল যেমনই হোক সেদিকে নজর দেওয়ার আগে তোমাকে নজর দিতে হবে আকিদার দিকে। আকিদায় যেন কখনো বেদাত না ঢোকে।’
বেদাতমুক্ত আকিদা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আকিদায় কীভাবে বেদাত ঢোকে তার একটি চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ তাহেরুল কাদেরি। তিনি সহি বুখারি থেকে জুল খুওয়াইছার হাদিস উদ্ধৃতি করেছেন। হাদিসটি এরকমÑএকবার নবীজি (সা.) গনিমতের সম্পদ বিতরণ করছেন। এমন সময় জুল খুয়াইছা বলল, হে মুহাম্মদ! ইনসাফের সঙ্গে বণ্টন করুন। নবীজি বললেন, আমি যদি ইনসাফ না করি তাহলে আল্লাহর জমিনে আর কে ইনসাফ করবে। এ হাদিস উদ্ধৃত করার পর তাহেরুল কাদেরি ইবনে তাইমিয়ার একটি ঐতিহাসিক ফতোয়া উল্লেখ করেন। ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, ‘পৃথিবীতে সর্বপ্রথম বেদাতকারী হলো জুল খুয়াইছা। সে আল্লাহর নবীর সঙ্গে বেয়াদবি করে আকিদাগত বেদাতের সূচনা করেছে।’ নবীজি বলেছেন, ‘সব বেদাত গোমরাহী। আর সব গোমরাহী জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।’ প্রখ্যাত এ হাদিসে আকিদাগত বেদাতের ব্যাপারে সাবধান করা হয়েছে। যে কারণে ইমাম গাজ্জালী অলি হওয়ার জন্য প্রথম বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন বেদাতমুক্ত নির্ভেজাল আকিদা।
অলি হওয়ার জন্য দ্বিতীয় যে কাজ করতে হবে সেটি হলো, তওবা। তবে এ কোনো সাধারণ তওবা নয়। এমন তওবা করতে হবে যেন আর কখনো গুনাহে জড়িয়ে না পড়ে। খালেস তওবা সম্পর্কে এক আল্লাহর অলি লিখেছেন, গুনাহের পর আল্লাহর কাছে লজ্জিত হওয়াই খালেস তওবা। যখন গুনাহর কথা মনে হবে তখন অন্তরে অশান্তি অনুভব হবে। গুনাহের কথা চিন্তা করে কখনো অন্তরে স্বাদ অনুভব করা যাবে না। অলি হওয়ার তৃতীয় আমল হলো মানুষের অধিকার পূর্ণরূপে আদায় করতে হবে। সবার অধিকার আদায় করা যদি তোমার সামর্থ্যে না কুলায় তাহলে অন্তত এ পর্যায়ে পৌঁছতে হবে, তোমার ওপর কারও কোনো অভিযোগ থাকবে না। তোমাকে দেখলে, তোমার কথা ভাবলে তোমার আত্বীয়স্বজন-প্রতিবেশী-সহকর্মী কারও মনে কষ্ট কিংবা বিরক্তি আসবে না। এ সম্পর্কে এক আল্লাহর অলি বলেন, অলি হওয়ার জন্য প্রথম শর্ত হলো মানুষ তো বটেই এমনকি কোনো প্রাণীও তোমার থেকে কষ্ট পাবে না। আখলাকের এ স্তরে যে উন্নীত হবে সে অলি হওয়ার রাস্তায় অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
চতুর্থ ও শেষ যে গুণটি অলি হওয়ার জন্য প্রয়োজন তা হলো, এলেম অর্জন করা। দুই ধরনের এলেম তোমাকে অর্জন করতে হবে। এক ধরনের এলেম হলো আল্লাহকে চেনার এলেম। যাকে বলে মারেফাত। আরেক ধরনের এলেম হলো আল্লাহর বিধান জানার এলেম। যাকে বলে শরিয়ত। এ দুই এলেম অর্জনের পর দুনিয়ার প্রচলিত যেসব এলেম আছে সেগুলো ওই পরিমাণ অর্জন করবে, যা তোমার প্রয়োজন।
আমরা যদি সংক্ষেপে বলতে চাই, অলি হওয়ার সহজ পথ চারটি। বিশুদ্ধ আকিদা, খালেস তওবা, অনুপম চরিত্র এবং যুগোপযোগী এলেম। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর অলি হিসেবে কবুল করে নিন। আমিন।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট
পীর সাহেব, আউলিয়ানগর