ক্ষমতার উদগ্র আকাক্সক্ষার পরিণতি আমাদের একেবারে চোখের সামনে। ভুলে যাওয়ার মতো সময় এখনো অতিবাহিত হয়নি। যারা নিজেদের রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক কর্মী, এমনকি রাজনীতিসচেতন বলে দাবি করেন, তারাও যদি এরই মধ্যে মাত্র সাড়ে ৯ মাস আগে দেশে কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে, সে ঘটনাগুলো বিস্মৃত হয়ে থাকেন, তাহলে বলতেই হয়, জাতির ভাগ্যে আরও দুঃখ-দুর্দশা অপেক্ষা করছে। দেশের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা এই ভূখণ্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে চরম, জঘন্যতম ঘৃণিত এক নিপীড়ক শাসকের হাতে অসংখ্য জীবনহানি ও চিরতরে পঙ্গুত্ববরণের বিনিময়ে জনগণের অর্জিত অভূতপূর্ব মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রধান ও দায়িত্বশীল দল হিসেবে ভাবমূর্তিসম্পন্ন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) যে ধরনের আচরণ শুরু করে তা তাদের মর্যাদার সঙ্গে মানানসই নয়। দলটির নেতাদের কাছ থেকে জনগণ আরও সংযম ও মিতাচার আশা করলেও তারা তাদের দায়িত্বহীন আচার-আচরণের মাধ্যমে দেশবাসীকে হতাশ করছেন। তারা যেন ভুলেই গেছেন, শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন উৎখাত করতে তাদের ভূমিকা প্রায় ছিলই না। বরং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে তারা নিরুৎসাহিত করেছেন এবং এ আন্দোলনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই বলেও একাধিক শীর্ষ নেতা বলেছেন। তবে আন্দোলন সফল হওয়ার পর তারা এর কৃতিত্ব দাবি করতে দ্বিধা করেননি।
বিএনপির মতো এত বড় একটি দল, যারা দীর্ঘ সময় দেশের ক্ষমতায় ছিল এবং দেশ পরিচালনায় অভিজ্ঞ, তারা শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। আন্দোলন তো দূরের কথা, বলা চলে তারা শেখ হাসিনার মতো একচ্ছত্র স্বৈরশাসকের গায়ে আঁচ লাগতে পারে, এমন কিছুই করতে পারেনি।
শেখ হাসিনার ক্ষমতার গণেশ উল্টে যাওয়ার পর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করার আগে বিএনপির যখন উচিত ছিল সাড়ে ১৫ বছর পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যর্থতার কারণ মূল্যায়ন করে দল পুনর্গঠনে মনোযোগ দেওয়া, তখন তারা চটজলদি ক্ষমতা দখলের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বালসুলভ চপলতায় চাপ সৃষ্টি করছে। শুধুই কী চাপ সৃষ্টি? অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপকে এই বলে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো এখতিয়ার নেই। কেবল নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল সরকারই এসব সিদ্ধান্ত নিতে পারে; ইত্যাদি। বিএনপিও যেহেতু অতীতে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেছে, অতএব আওয়ামী লীগের মতোই বিএনপির পেশি স্ফীত করার লোকের অভাব ছিল না, এখনো নেই। তারা অন্ধকার থেকে আলোতে বেরিয়েই আওয়ামী লীগের অবৈধ অর্থ কামানোর ফেলে যাওয়া সব উৎস- হাটবাজার, বন্দর-টার্মিনালসহ, ঘাট-বালুমহাল ইত্যাদি জোরজবরদস্তি করে চাঁদা আদায়ের যতগুলো ক্ষেত্র আছে, সেগুলো দখল করে ঢালাওভাবে চাঁদা আদায় করছে। যেসব করপোরেট প্রতিষ্ঠান এত দিন আওয়ামী লীগের প্রভাবের আওতায় ছিল অথবা আওয়ামী লীগকে চাঁদা দিয়ে তাদের আশীর্বাদ গ্রহণ করত, সেসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা আগ বাড়িয়ে বিএনপির লোকজনকে তোয়াজ করছে। বিএনপির নেতা ও ক্যাডাররা যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে অন্যের জমি, ব্যবসা ও ঘের দখল করছে। যেহেতু বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই, অতএব তারা মাঠ ফাঁকা থাকলে অবৈধ সুযোগসুবিধার ভোগদখলে অভিন্ন আচরণ করে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের শিক্ষা থেকে বিএনপি আদৌ কোনো শিক্ষা নেয়নি।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের সামান্য কিছুসংখ্যক নেতা ও লুটেরা গ্রেপ্তার হয়েছে। অন্য অধিকাংশই দেশত্যাগসহ আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় বিএনপি সম্ভবত আওয়ামী লীগের ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-এর মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাশূন্য একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। তাদের ধারণা এবং ভয় হলো, অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ২০২৬ সালে জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে কথা বলছে, ওই সময়ের মধ্যে দেশে ভিন্ন ধরনের যে রাজনৈতিক মেরুকরণ হতে পারে, তাতে বিলম্বে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিএনপি এককভাবে সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না-ও পেতে পারে।
কী আছে এই ক্ষমতায়? বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর কোন নেতা অথবা কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গিয়ে দেশ বা জনগণের জন্য কী করেছে? তারা কী দেশে তাদের প্রতিশ্রুত গণতন্ত্র এনেছে? তারা কী বিচার বিভাগকে স্বাধীন নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করেছে? দেশে কি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? না, কোনো কিছুই হয়নি! দেশের সবকিছু স্বাধীনতাপূর্ব পাকিস্তান আমলের গণতন্ত্রহীন অবস্থায় আছে। রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দল-মতনির্বিশেষে দেশে কেউ কি শেখ মুজিবুর রহমানের তুলনায় অন্য কাউকে বড় নেতা মনে করে? তা না করা সত্ত্বেও শেখ মুজিবের ব্যর্থতা এবং তার কথা ও কাজের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য ছিল না বলে, তার কড়া সমালোচনা করতে কেউ তাকে ছাড় দেয় না। তিনি বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলে বলেই নেতা হয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে সব নিষিদ্ধ করে তার পছন্দের ‘সংসদীয় ব্যবস্থা’র কবর রচনা করে একদলীয় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বাক-ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলে মুখে ফেনা তুলতেন, কিন্তু চারটি সংবাদপত্র রেখে সব সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করেন। তিনি তার নিজস্ব ভাবমূর্তি গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে প্রমাণ করেছেন, তিনি যা বলতেন তা তিনি তার বিশ্বাস থেকে বলতেন না। তিনি মনভোলানো কথা বলে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো জনগণকে প্রলুব্ধ করতেন তার পেছন পেছন গিয়ে অজ্ঞাত গহ্বরের অন্ধকারে আটকা পড়ে, যে অন্ধকার থেকে জনগণ আজও মুক্তি পায়নি।
ভারত বিভক্তির মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতাপূর্ব পাকিস্তানের আর্থসামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখতে পারেনি। রাজনৈতিক স্বাধীনতা তো ছিলই না। ছিটেফোঁটা উন্নয়ন যে হয়নি, তা নয়। নতুন কিছু শিল্প-কারখানা আর কিছু দালানাকোঠা নির্মিত হয়েছিল। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়েছিল। এই তো। কিন্তু সেই স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন ও শোষণে অতীষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে শাসকগোষ্ঠী, সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ জমে উঠতে শুরু করেছিল, তার ইতিবাচক দিক ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার চেতনা জাগ্রত হওয়া, যা পূর্ব বাংলা অখণ্ড ভারতের অংশ হিসেবে থাকলে কখনো সম্ভব হতো কি না, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এই চেতনায় জাতি উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বলে সম্ভাব্য স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভে সফল হয়েছে।
১৯৭৪ সালে ভারতের খ্যাতিমান সাংবাদিক খুশবন্ত সিং শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। তিনি শেখ মুজিব সম্পর্কে তার ‘অন ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ’ নামের গ্রন্থে মন্তব্য করেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে তার দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে কথা বলেন। তার আশাবাদ সংক্রামক।’ একই গ্রন্থের অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘প্রশাসনের প্রতিটি বিভাগের কাজে তিনি হস্তক্ষেপ করেন।
তিনি ক্ষমতা অর্পণে অস্বীকৃতি জানান এবং এর চেয়েও গুরুতর বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক সমর্থকদের সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি যখন-তখন সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেন।’ অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে অপসারণ করার কারণ জানতে চাইলে শেখ মুজিব যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, সে সম্পর্কে খুশবন্ত সিং বর্ণনা করেছেন, “তিনি রাগে জ্বলে ওঠেন এবং টেবিল চাপড়ে উত্তর দেন, ‘গণতন্ত্রে মন্ত্রী নিয়োগ ও বরখাস্ত করা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ এখতিয়ার। তিন বছরে আমি নয়জন বা দশজন মন্ত্রী পরিবর্তন করেছি। আপনার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কজন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছেন?’”
শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘দেবত্ব’ বজায় রাখতে দলে কোনো উত্তরাধিকারী সৃষ্টি করা পছন্দ করেননি। তাজউদ্দীন আহমদ সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হতে পারতেন। সে কারণেই হয়তো তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপসারণ করা হয়েছিল। শেখ মুজিবের উত্তরাধিকারী হিসেবে তার দল বেছে নিয়েছিল তার প্রবাসী কন্যা শেখ হাসিনাকে। সন্দেহ নেই আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করে ১৯৯৬ সালে তার নেতৃত্বে দলকে দেশের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করায় তার ভূমিকা অসামান্য। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে হোক, অথবা পিতার জিনের প্রভাবেই হোক, শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতিটি ক্ষেত্রে পিতা শেখ মুজিবের পদাঙ্কই অনুসরণ করেছেন। তবে দলীয় নেতা-কর্মীদের সন্তুষ্ট করতে শেখ হাসিনা তার পিতার মতো যখন-তখন সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলতেন না। তবে তিনি তার পিতার ‘আমিত্ব’র উত্তরাধিকার পুরোপুরি নিজের মাঝে স্থাপন করেছিলেন। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অর্থহীনভাবে খড়গহস্ত না হয়ে এবং জীবনভর ক্ষমতায় থাকার উগ্র মানসিকতা পরিহার করে দেশের উন্নয়নে মনোযোগ দিলে কাগজকলমে উন্নয়ন খাতে যে বিপুল অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে, তা প্রকৃতই সঠিকভাবে ব্যয় হলে দেশ আরও সমৃদ্ধ হতে পারত।
কিছু উঁচু অট্টালিকা, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল ইত্যাদি অবশ্যই উন্নয়ন, কিন্তু এগুলো প্রয়োজনের পাশাপাশি নান্দনিক উন্নয়ন। সময়ের সঙ্গে এসব আসবেই। ‘আমি মোবাইল দিয়েছি, আমি টেলিভিশন দিয়েছি, আমি ইন্টারনেট দিয়েছি,’ এসব কথামালা কোনো সভ্য, ভদ্র ও সুশাসকের দাবি হতে পারে না। সময়ের প্রয়োজনে বিশ্বের এমনকি অতিদরিদ্র দেশও এখন এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে। কিন্তু ওই সব দেশের শাসকরা এমন হাস্যকর বালখিল্য আচরণ করেন কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। শুধু তা-ই নয়, ‘অমুক’ না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসত না, পাকিস্তানের গোলাম হয়ে থাকতে হতো, এসব দাবির মধ্যেই বা কতটা যথার্থতা আছে। বিশ্বের যে কোনো দেশের ইতিহাস পাঠে এটা সুস্পষ্ট যে ওই সব দেশের দুঃসময়ে জনগণকে সঠিক পথ দেখানোর অনিবার্য প্রয়োজনে জনগণের ভিতর থেকেই কেউ না কেউ বেরিয়ে আসে এবং নেতৃত্ব গ্রহণ করে। এমন নেতার আবির্ভাব ঘটে ‘সময়ের সন্তান’ হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের প্রায় ৭০টি ছোটবড় দেশ স্বাধীন হয়েছে, যার বেশির ভাগ এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো তাদের সাবেক উপনিবেশগুলোর জনগণের মাথায় হাত বুলিয়ে অথবা জননেতাদের চুম্বন করে স্বাধীনতা দিয়ে যায়নি। প্রায় প্রতিটি দেশকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়েছে অথবা বিদেশি শক্তির শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন করতে হয়েছে। দেশগুলোর জনগণ অত্যাচার ও সব ধরনের দলনপীড়নের মধ্যেও এবং জানমালের বিপুল ত্যাগ স্বীকার করার পরও যখন তাদের অবস্থানে অটল থেকেছে, ঔপনিবেশিক শক্তিকে তখন পাততাড়ি গুটিয়ে পালাতে হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার কন্যা শেখ হাসিনা পৃথক দুটি সময়ে দেশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জনগণের ওপর তাদের দুঃশাসন চাপিয়ে দিয়ে ভিন্ন দুটি প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ধরনের ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়েছেন। শেখ হাসিনা শতব্যস্ততা সত্ত্বেও রাতের ঘুম হারাম করে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় এবং ভোরে ফজর আদায় করার পর পবিত্র কোরআন শরিফ তিলাওয়াত এবং তাসবিহ-তাহলিল করা সত্ত্বেও কোরআনের বাণীর মর্ম উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। শাসকদের ক্ষমতা দান ও ক্ষমতাচ্যুত করা সম্পর্কে কোরআনের সুরা আল-ইমরানে বলা হয়েছে : ‘হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা প্রদান কর, এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নাও; যাকে ইচ্ছা তুমি ইজ্জত দান কর, আর যাকে ইচ্ছা অপমানিত কর। কল্যাণ তোমার হাতেই। নিশ্চয়ই তুমি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ তিনি নিশ্চয়ই এটা পাঠ করেছেন, কিন্তু ক্ষমতার জাঁকজমক ও ব্যক্তিগত দম্ভে আল্লাহর বাণীকে বিশ্বাস করেননি। ফলে তার ললাটের লিখন যা ছিল, তাই ঘটেছে।
তার বিদায়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং অন্যান্য দল আবারও একটি অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে বাড়াবাড়ি শুরু করেছে, তা কোনো শুভ ইঙ্গিতবহ নয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তাদের প্রধান তিন প্রতিশ্রুতি : (এক) কাক্সিক্ষত সংস্কার সাধন, (দুই) বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে হত্যা, গুম, অপহরণ, লুণ্ঠনসহ যেসব অপরাধ করেছে, তার বিচার সম্পন্ন করা এবং (তিন) জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর সহযোগিতাকে যেভাবে মর্যাদাপূর্ণ বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে কাজে লাগাচ্ছে, সেগুলোকে অবমূল্যায়ন ও হালকাভাবে গ্রহণ করা হলে দেশকে কার্যত আরেকবার একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। এমন একটি পরিস্থিতির জন্যই আওয়ামী লীগ ওত পেতে আছে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার জন্য। রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি যত শিগগির তা অনুধাবন করে দলের ইতোমধ্যে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়া নেতা-কর্মীর লাগাম টেনে ধরতে পারবে, দেশ-জাতির জন্য তা ততটাই কল্যাণকর হবে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক