সুরা আল মূলক মানুষের চলার পথের গাইড মহান আল্লাহ প্রদত্ত আল কোরআনের একটি বরকত ও ফজিলতময় সুরা। প্রতি রাতে এ সুরা পাঠ করলে কেয়ামতের দিন পাঠকারীর জন্য সে সুপারিশ করবে। এ সুরা পাঠকারীকে কবরের আজাব থেকেও রক্ষা করবে। সুরা আল মূলক সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর রাজত্ব, কর্তৃত্ব ও মহৎ বর্ণনার মাধ্যমে শুরু করা হয়েছে। এটি পবিত্র কোরআনের ৬৭তম সুরা। ৩০ আয়াতবিশিষ্ট এ সুরাটি মক্কায় অবতীর্ণ। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এ সুরাটির এক থেকে চার আয়াত পর্যন্ত আল্লাহর ক্ষমতা বর্ণনা করা হয়েছে নিপুণভাবে। যাতে আমরা কখনো মহান আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার মতো ভুল করে আখেরাতের জীবনে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে না আনি। ৫ থেকে ১৫ আয়াত পর্যন্ত দুনিয়ার জীবন শেষের অনন্ত জীবন অর্থাৎ জাহান্নাম ও জান্নাতের বিষয়ে আমাদের অভিহিত করা হয়েছে। যাতে আমরা দুনিয়ার জীবনে এ দুটির পার্থক্য অনুধাবন করে কোনটির জন্য সঞ্চয় করব সে সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি। সুরা আল মূলকের ২৩ থেকে ২৭নং আয়াতে বিপদের প্রস্তুতি, বিপদ কবে ঘটবে এবং বিপদ নিয়ে মানুষের কৌতূহল বর্ণিত হয়েছে। ২৮ থেকে ৩০নং আয়াতে সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর দয়া এবং বান্দার প্রতি তাঁর নেয়ামতের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহতায়ালার কিতাবে একটি সুরা আছে যার আয়াত মাত্র ৩০টি, কিন্তু কেয়ামতের দিন এ সুরা পাঠকারীর পক্ষে সুপারিশ করবে এবং তাদের জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে দাখিল করবে, সেই সুরা হলো মূলক। (আবু দাউদ ১৪০০? তিরমিজি ২৮৯১)।
আল্লাহর ক্ষমতার কোনো সীমা নেই। তাঁর কর্তৃত্বও সীমাহীন। আল্লাহর সার্বভৌমত্বও প্রশ্নাতীত। সুরা আল মূলকের দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যিনি মৃত্যু ও জন্ম সৃষ্টি করেছেন, যাতে করে তিনি তোমাদের পরীক্ষা করে নিতে পারেন যে, কর্মক্ষেত্রে কে তোমাদের মধ্যে উত্তম। তিনি সর্বশক্তিমান ও অসীম ক্ষমাশীল।’ এ আয়াতের মাধ্যমে সুস্পষ্ট করা হয়েছে যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জীবন ও মৃত্যুদাতা এবং তিনি মৃত্যু থেকে মুক্ত। ৩ ও ৪নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তিনি সাত আসমানকে স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোনো খুঁত দেখতে পারবে না। আবার তাকাও, কোথাও কি তুমি কোনো ত্রুটি দেখতে পাও? তারপর সকালসন্ধ্যায় তুমি দৃষ্টি ফেরাও, দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে তোমার কাছে ফিরে আসবে?’
দুনিয়ার জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। আখেরাতের জীবন অনন্ত। দুনিয়ার জীবনে আমরা আখেরাতের জীবনের জন্য সঞ্চয় করতে না পারলে চূড়ান্তভাবে হতাশ হতে হবে। সুরা মূলক কবরের আজাব থেকে প্রতিবন্ধক রচনা করবে। কবরের আজাব কত ভয়াবহ সে সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। রসুল (সা.) তাঁর উম্মতদের নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা কবরের আজাব থেকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর (মুসলিম শরিফ ২৮ ৬৭)।’
রসুল (সা.)-কে আল্লাহ গুনাহ মুক্ত রেখেছেন। কোনো গুনাহ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তারপরও তিনি এই বলে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ আমি কবরের আজাব থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। জাহান্নামের শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আরও আশ্রয় প্রার্থনা করছি জীবনমৃত্যু ও দাজ্জালের ফেতনা থেকে (বুখারি শরিফ)। দোজাহানের সরদার রসুল (সা.) সুরা সাজদাহ ও সুরা মূলক পাঠ না করে ঘুমাতেন না (তিরমিজি শরিফ ৩৪০৪)। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার একান্ত কামনা যে এ সুরাটি আমার প্রত্যেক উম্মতের অন্তরে গেঁথে থাকুক (ইবনে কাসির)।’
রসুল (সা.)-এর সাহাবারা সুরা মূলক আমল করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, তোমরা সুরা মূলক শিখে নাও এবং নিজেদের স্ত্রী ও সন্তানদের শেখাও। এটা কবরের আজাব থেকে রক্ষা করবে এবং কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে এ সুরা পাঠকারীর পক্ষে কথা বলে তাকে মুক্ত করবে। সুরা মূলক যেকোনো সময় পড়া যায়। তবে রাতের বেলায় এ সুরা পড়া উত্তম। পবিত্র কোরআনের প্রতিটি সুরা অর্থ বুঝে পড়া সওয়াবের কাজ। কাজেই সুরা মূলকের আলোয় নিজেদের জীবন আলোকিত করতে অর্থ জেনে পড়া উত্তম। সুরা আল মূলকের মাধ্যমে আমরা জন্ম, মৃত্যু ও সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং মানুষের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে অভিহিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আল্লাহকে ভয় করে যে বান্দা তাঁর নির্দেশিত সরল পথ বা সিরাতে মুস্তাকিমের ওপর অটল এবং অবিচল থাকবে এবং দুনিয়ার জীবনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে তার জন্য সুরা মূলকে ঘোষণা করা হয়েছে মহাপুরস্কার। আমাদের সবাইকে সেই পুরস্কার লাভের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। তার বদলে আমরা যদি ভুল পথে চলি, যদি আল্লাহ ও তাঁর রসুলের (সা.) নির্দেশিত পথ ভুলে বিপথে যাই, তবে আমাদের জন্য এক ভয়াবহ পরিণাম অপেক্ষা করছে। সুরা আল মূলকে আখিরাতে মানুষ দুনিয়ার জীবনের ভুলের জন্য কীভাবে আফসোস করবে সে বিষয়ে চমৎকারভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সুরা মূলক নিয়মিত পাঠ এবং আমল করার তৌফিক দান করুন।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক