গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস করা হয়েছে। বিশেষ করে পুঁজিবাজার, ব্যাংক প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস, এনার্জি সেক্টরে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। একইসঙ্গে বিদেশেও অনেক টাকা পাচার হয়েছে। এলডিসি উত্তরণের মতো জায়গায় এদেশ এখন নেই। কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, বাণিজ্য অনিশ্চয়তা এবং দুর্বল অর্থনৈতিক সূচক এই উত্তরণের প্রস্তুতিতে বড় বাধা। এলডিসির বিষয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে এবং প্রস্তুতি নিতে হবে। এছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় সংলাপ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বুধবার রাজধানীর শেরাটন হোটেলে চেঞ্জ ইনেশিয়েটিভ আয়োজিত ‘বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ : প্রস্তুতি ও বাস্তবতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।
চেঞ্জ ইনেশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক মো. জাকির হোসাইন খানের সভাপতিত্বে বৈঠকে বক্তব্য দেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম প্রধান সমন্বয়ক সাদিয়া ফারজানা দিনা, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সোয়াস’র অধ্যাপক মুশতাক খান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব ও জাতিসংঘ উইং প্রধান এ কে এম সোহেল, বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের প্রধান সম্পাদক আবু রুশদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক (গবেষণা) ড. ওমর ফারুক, বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়ন চেম্বার অফ কমার্সের চেয়ারপার্সন নুরিয়া লোপেজ, এজেন্স ফ্রঁসেজ দ্য ডেভেলপমেন্ট (এএফডি)-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর সিনথিয়া মেলা, ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিক অ্যাডভাইজার মি. ওয়াইস প্যারে, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভুঁইয়া, ঢাকা ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্সের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, ড একেএম ওয়াসিকুল করিম প্রমুখ। বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চেঞ্জ ইনেশিয়েটিভের গবেষণা প্রধান ইশতিয়াক বারী।
বক্তারা আরও বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, গুরুতর অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা এবং অপর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে উত্তরণের ফলে সম্ভাব্য বাংলাদেশের জনস্বার্থ এবং দীর্ঘমেয়াদি গভীর নেতিবাচক প্রভাবের সম্মুখীন হতে পারে। যদিও সংখ্যাগতভাবে বাংলাদেশ যোগ্যতার মানদণ্ড পূরণ করেছে। কিন্তু অনির্ভর তথ্যভিত্তিক বর্তমান বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে এই উত্তরণ বিলম্বের চেষ্টা করা আবশ্যক। সম্প্রতি জাতিসংঘের সিডিপি ২০২৫-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রদত্ত পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বেসরকারি খাতের আস্থার ঘাটতির কথা উল্লেখ করে, আলোচনায় একটি যৌক্তিক সময়সীমা নির্ধারণে প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়, যাতে স্মুথ ট্রান্সজিশন স্ট্র্যাটেজি বাস্তবায়ন, গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তি সুরক্ষা এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এর উন্নয়নের ফাও বয়ান-ভুয়া পরিসংখ্যান, ভেঙে পড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং রপ্তানির ভিত্তি বিপজ্জনকভাবে সংকীর্ণ অবস্থায় আছে। এলডিসি উত্তরণ ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে হতে পারে না। প্রকৃত উত্তরণের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে নির্বাচিত সাংসদের মাধ্যমে ম্যান্ডেট প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক বৈধতা ছাড়া কোনো মাইলফলকই অর্থবহ নয়।
জোনায়েদ সাকি বলেন, বর্তমানে বিশ্ব বাণিজ্যে শ্রম ও পরিবেশগত মানকে অগ্রাধিকার প্রদান করছে। এ প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তন ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশকে কৌশলগত সুবিধা অর্জনের জন্য এলডিসি উত্তরণে সময় নিতে হবে। নির্ভরযোগ্য তথ্য, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং একটি জাতীয় সংলাপ ছাড়া এই উত্তরণে তাড়াহুড়ো করা আমাদের অর্থনৈতিক অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
সাদিয়া ফারজানা দিনা বলেন, নিয়মিত তথ্য নিরীক্ষা এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তথ্য ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
অধ্যাপক মুশতাক খান বলেন, বাংলাদেশ উত্তরণের পথে রয়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতিমূলক কাজ ছাড়াই। আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি দুর্নীতিতে জর্জরিত এবং পোশাক খাতের বাইরে আমাদের রপ্তানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ঠুটো জগন্নাথ। এই অবস্থায় চামড়া ও খাদ্যের মতো শিল্পগুলোকে অরক্ষিত শুল্কের মুখে ঠেলে দেবে, যা ভারতীয় ও চীনা প্রতিযোগিতার মুখে ধসের ঝুঁকি তৈরি করবে।
এ কে এম সোহেল বলেন, আমরা একতরফাভাবে স্থগিত করতে পারি না, তবে খরচ, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ঘাটতি বিষয়ক সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অতিরিক্ত সময় প্রদানের জন্য একটি ন্যায্য যুক্তি উপস্থাপন করতে পারি। ঋণের শর্তাবলী ইতিমধ্যে কঠোর হচ্ছে, শুল্কমুক্ত সুবিধা শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং কৌশলগত সংস্কারের জন্য আমাদের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে।
আবু রুশদ বলেন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, আঞ্চলিক উত্তেজনা এবং বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যে বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরীণ ফাটল উপেক্ষা করার মতো অবস্থায় নেই। জনগণ ১৭ বছর ধরে সুষ্ঠু নির্বাচন দাবি করেছে এবং গণতন্ত্রের নামেও তা পায়নি। যখন জনগণের অধিকার ও মর্যাদা অবহেলিত থাকে, তখন রোলস রয়েসের মতো সাফল্যের প্রতীক দেখাবেন না। সমাধান অবশ্যই রাজনৈতিক হতে হবে এবং তা জরুরিভাবে আসতে হবে।
বিডি প্রতিদিন/এমআই