সিঁড়ি ঘরের দরজা খুলে বসে আছে ইরাম। তার চোখ হারিয়ে আছে আষাঢ়ে আকাশে। বিশাল এক প্যাস্টেলে নীল রঙের ক্যানভাস টাঙানো। জলরঙের দারুণ খেলা চলছে।
এখন বৃষ্টি নেই। মেঘবাড়ির চিত্রশিল্পীদের ঘুম ভেঙেছে। মেঘের জাদুকরেরা জাদু দেখাচ্ছে। আর মুগ্ধ হয়ে সেই জাদু দেখছে ইরাম। একদল ধুসর মেঘ ভেসে এলো। ধুসর মেঘের ফাঁকে ফাঁকে ভাসছে শাদা মেঘের কার্পাসতুলো।
এই মেঘ কোথায় যাও?
কোথায় তোমার বাড়ি?
কী কাজ তোমার এখন?
কে শোনে কার কথা! হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে একঝাঁক পাখি হয়ে গেল মেঘগুলো। উড়ে চলে গেল দূরে। আর মুহূর্তেই আরও এক দল মেঘ চলে এলো সেখানে। হাওয়ায় কুণ্ডলি পাকাতে পাকাতে মেঘগুলো হয়ে গেল আস্ত একটা এরোপ্লেন। সেও উড়ে চলে গেল দূরে। আরও এক দল মেঘ হাজির হলো। কী আঁকা হবে এবার জানে না ইরাম। দলা পাকাতে পাকাতে বিশাল এক মেঘের হাতি নাচ জুড়লো। মেঘের ঘোড়ায় চড়ে ছুটে এলো মেঘের রাজপুত্র।
চোখ সরানো যাচ্ছে না। একের পর এক কাণ্ড ঘটে চলেছে। উত্তরে মেঘের পাড়ায় দেখা যাচ্ছে ঢাল তলোয়ার হাতে একদল সৈন্য ছুটে আসছে। আর দক্ষিণ দিকে তাকাতেই দেখা গেল ছুটে আসছে আরও একদল সৈন্য। এরপর সেই লড়াই শুরু। তরবারির সঙ্গে তরবারির ঠু০কোঠুকিতে জ্বলে উঠছে আলোর ঝলকানি।
ইরাম বলে ওঠে, ‘যুদ্ধ বন্ধ কর। শান্তি চাই।’
মেঘের সৈন্যরা সঙ্গে সঙ্গে উধাও। ইরাম দেখে এক পাল গরু, ছাগল, ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে মেঘপাড়ায়। মেঘের রাখাল বাঁশি বাজাচ্ছে।
মেঘ ফড়িঙেরা উড়ছে।
মেঘের পাখিরা উড়ছে।
একটা ফুলবাগানে ফুটে আছে থোকা থোকা মেঘফুল।
মেঘের নদী জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে পালতোলা মেঘনৌকা।
মেঘবুড়ি গল্প শোনাচ্ছে মেঘ শিশুদের।
ইরাম দেখে, মেঘ কিশোর ঘুড়ি উড়াচ্ছে। মেঘা কিশোরী খোঁপায় কদমফুল গুঁজে ছুটে বেড়াচ্ছে।
ইরাম দেখে একটা দারুণ ইশকুল। ইশকুলের ছেলে-মেয়েরা মেঘের আইসক্রিম খাচ্ছে মজা করে।
হঠাৎ হাজির হয় মস্ত বড় এক মেঘের ড্রাগন। হা করে রাশি রাশি মেঘ ছড়াতে থাকে সে। আর সেই মেঘের ভিতরে হারিয়ে যায় সব। ইরাম দেখে সব এলোমেলো করে ভেসে বেড়াচ্ছে বিশাল এক মেঘের তিমি।
ইরাম... ইরাম...। ছাদ থেকে নেমে এসো। আকাশে অনেক মেঘ। বৃষ্টি নামবে।
আকাশ থেকে চোখ সরাতে ইচ্ছে করে না ইরামের। মেঘের পাড়ায় ছবি আঁকাআঁকি চলতেই থাকে।
ইরাম ভাবে মেঘেদের মতো ছবি আঁকতে পারে না কেউ। আকাশের মতো এত বড় ক্যানভাস আর কোথাও নেই।
হঠাৎ মেঘের পাড়ায় একটা মানুষকে দেখতে পায় ইরাম। লম্বা মেঘের জোব্বা পরে আছে লোকটা। লম্বা লম্বা দাড়ি। একটা মেঘের চেয়ারে এসে বসে পড়ে সে। সামনে টেবিল, দোয়াত-কালি, খাতা। শাদা পালক লাগানো কলম হাতে তার। একটা কবিতা লিখছে সে। গাঢ় মেঘ দিয়ে। সিঁড়ি ঘরের দরজাতে বসেই সে লেখা পড়া যায়। লেখার সঙ্গে সঙ্গেই পড়ে ফেলছে ইরাম।
মেঘের খাতার লেখা উঠছে-
নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
বাদলের ধারা ঝরে ঝর-ঝর,
আউশের খেত জলে ভর-ভর,
কালী-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ্ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে মন দিয়ে কবিতা পড়ছে ইরাম। কবিতার ভিতরে হারিয়ে যাচ্ছে সে। হঠাৎ কবিতার শব্দগুলো হারিয়ে যেতে থাকে। আকাশের দেখা দৃশ্যগুলো হারিয়ে যেতে থাকে। মন খারাপ হয় ইরামের। আকাশে কোনো ছবি নেই। আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে ছাদের দিকে চোখ রাখতেই ইরাম লক্ষ করে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। রিমঝিম রিমঝিম ছন্দে বৃষ্টি নামছে। নীল ক্যানভাসে কোনো ছবি নেই। ছবি থাকবে কী করে! ছবিরা তো এখন বৃষ্টি হয়ে নামছে।