একসময় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছিল বন্য হাতির অবাধ বিচরণ। কিন্তু রোহিঙ্গা বসতি, সামরিক স্থাপনা, সীমান্তে কাঁটাতার, মাইন পাতা ও রেললাইন নির্মাণে হাতির চলাচলের করিডর ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় ১০ হাজার একর বনভূমি দখল করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বসতি গড়ে ওঠে—যা ছিল হাতির মূল আবাসস্থল। এছাড়া দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ তিনটি করিডর ও ১৬টি ক্রসিং পয়েন্ট অতিক্রম করায় হাতির চলাচল আরও বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
আইইউসিএনের ২০১৬ সালের জরিপে দেশে ২৬৮টি বন্য হাতি শনাক্ত হয় এবং প্রজাতিটিকে ‘মহাবিপদাপন্ন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ৯ বছরে ১৪৬টি হাতি মারা গেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ জানান, বান্দরবানের ঘুমধুম করিডর হয়ে নাইক্ষ্যংছড়ির ভেতর দিয়ে মিয়ানমারে যাতায়াত করত হাতির পাল। ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের আগমনের পর সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করলে সে করিডরটি বন্ধ হয়ে যায়। করিডর বন্ধ হয়ে টেকনাফ ও উখিয়া অঞ্চলে ৩৫টি হাতি আটকা পড়েছে। রেজু খালের করিডরও সামরিক স্থাপনা ও মাছের খামারের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। রেললাইন নির্মাণে করা ওভারপাস ও আন্ডারপাস হাতির জন্য উপযোগী নয়, ফলে ব্যবহারও কম।
তিনি আরও বলেন, এভাবে করিডর বন্ধ হয়ে আটকে পড়ার কারণে হাতি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন বিভাগ সম্প্রতি হাতি রক্ষায় একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। হাতির সংকটগুলোকে চিহ্নিত করে দ্রুত মাঠপর্যায়ে হাতি সংরক্ষণে কাজ করতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াসিন নেওয়াজ বলেন, ১২টি করিডরের অধিকাংশই দখল বা অবকাঠামো নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্ত। হাতি রক্ষায় প্রশাসন ও স্থানীয়দের সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি।
এদিকে বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান মানুষ-হাতি সংঘাত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। বিশেষ করে শেরপুর, নেত্রকোনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ সংঘাত বেশি ঘটছে। মানুষের অনুপ্রবেশ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হাতির আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ায় হাতিগুলো মানুষের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে।
দেশের বন বিভাগের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৭-২০২১ সাল পর্যন্ত মানুষ-হাতি দ্বন্দ্বে কমপক্ষে ৫০ হাতি মারা গেছে। কেবল ২০২১ সালেই মানুষের সঙ্গে হাতির সংঘাতের ঘটনায় রেকর্ড সর্বোচ্চ ৩৪টি হাতি মারা যায়। এর পরবর্তী বছরে তিনটি, ২০২৩ সালে দুটি এবং গত বছর একটি হাতি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
হাতির প্রতি অসহনশীল আচরণের জন্য সরকারের রয়েছে বিভিন্ন আইন ও শাস্তির বিধান। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি এখন পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী কেউ কোনো বাঘ বা হাতি হত্যা করলে ওই অপরাধের জন্য সেই ব্যক্তি জামিন অযোগ্য হবেন এবং তিনি সর্বনিম্ন দুই বছর এবং সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ১ লাখ এবং সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন
উল্লেখ্য, আজ ১২ আগস্ট বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক হাতি দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য—‘মাতৃতান্ত্রিক নেতৃত্ব ও স্মৃতি’।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল