বিশ্বাস করে ব্যাংকে টাকা রেখে এখন জিম্মি লাখো গ্রাহক। ব্যাংকে ব্যাংকে ধরনা দিয়েও নিজের জমানো টাকা তুলতে পারছেন না। টাকা চাইলে নানা টালবাহানা আর অজুহাত। ঋণ কেলেঙ্কারিতে দুর্বল হয়ে যাওয়া ব্যাংকের ক্ষেত্রেই এ ঘটনা বেশি।
এসব ব্যাংক সংস্কার ও তারল্য সহায়তার পরও গ্রাহকের জমা অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। ফলে দীর্ঘদিন থেকে অপেক্ষা করে থাকা গ্রাহকের প্রত্যাশা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। তাঁদের আস্থায় চিড় ধরেছে। এ ঘটনা শুধু ঢাকা নয়, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলারও প্রায় একই চিত্র।
২০২৪ সালে ক্ষমতার পালাবদলে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই আর্থিক খাতকে স্থিতিশীল করতে নানা পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংকগুলোর ১৪টি পর্ষদ বিলুপ্ত করা হয়, প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা নতুন করে ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়। সবল ব্যাংক থেকে টাকা ধারের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপারিশ ও ঋণাত্মক কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স ডিমান্ড লোনে পরিবর্তন করা হয়। এসব পদক্ষেপের ফলে ছোট অঙ্কের আমানতকারীরা কিছু অর্থ তুলতে পারলেও বড় অঙ্কের সঞ্চয় ফেরত পাওয়া অনেকের জন্য এখনো দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে।
কিছু কিছু দুর্বল ব্যাংক মাসে পাঁচ হাজার টাকাও দিতে পারছে না, আর গ্রাহকদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিচ্ছেন শাখা ম্যানেজাররা।
কক্সবাজারের মহেশখালীর বাসিন্দা শাহিদা নূর, যিনি নিজের পালিত হাঁস-মুরগি বিক্রি করে ইউনিয়ন ব্যাংকের বদরখালী শাখায় লাখ খানেক টাকা জমিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে সেই সঞ্চয়ের সামান্য অংশ তুলতে ব্যাংকে গেলেন, তখন জানতে পারলেন ব্যাংকে টাকা নেই। অনেক অনুরোধের পর তাঁকে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলো, তাও দুই সপ্তাহ পর। একই ধরনের ভোগান্তির শিকার স্কুল-শিক্ষক আবদুল কাদের। তিনি এক লাখ ২৭ হাজার টাকা তুলতে ১৮ বার ব্যাংকে গিয়েও এক হাজার টাকা হাতে পাননি।
এই চিত্র শুধু শাহিদা বা কাদেরের নয়, এটি এখন গ্লোবাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মতো বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রায় লাখো গ্রাহকের প্রতিদিনের বাস্তবতা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এসব ব্যাংকে আমানত তোলার হিড়িক পড়েছিল। সেই চাপ এখনো সামলে উঠতে পারেনি ব্যাংকগুলো। গ্রাহকরা বলছেন, দিনের পর দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পরও টাকা পাচ্ছেন না; বরং প্রতিনিয়ত তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে নানা অজুহাতে।
বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারেও তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েও সংকট কাটাতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ফলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন শাখায় টাকা তুলতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, কর্মকর্তাদের অসহযোগিতামূলক আচরণ এবং নানা অজুহাতে গ্রাহকদের ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসা, সন্তানের স্কুলের বেতন কিংবা ব্যবসার জরুরি প্রয়োজনেও টাকা না পেয়ে গ্রাহকদের মধ্যে বাড়ছে ক্ষোভ ও হাহাকার।
ফেনীর ইউনিয়ন ব্যাংকের গ্রাহক কবির আহমেদ পাঁচ বছর ধরে মেয়ের বিয়ের জন্য সঞ্চয় করছিলেন। ২০২৪ সালের জুনে মেয়ের বিয়ের তারিখ ঠিক হলেও ব্যাংক থেকে ছয় লাখ টাকা উত্তোলন করতে না পারায় বিয়ে আটকে গেছে। নানাভাবে তদবির করেও ব্যাংক পুরো অর্থ ফেরত দিতে রাজি হয়নি। মেয়ের বিয়ের জন্য ২০২০ সালে টাকা জমানো শুরু করেন। ২০২৪ সালের জুন মাসে সেই সঞ্চয়ের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়। এরই মধ্যে মেয়ের বিয়ের কথা পাকা করে রেখেছিলেন কবির। কিন্তু এরই মধ্যে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন। শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের দায়িত্ব নেয় নতুন সরকার। ভঙ্গুর অর্থনীতির দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়সম চাপের মুখে পড়তে হয় সরকারকে। তাই দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে ধৈর্য ধরার সিদ্ধান্ত নেন কবির আহমেদ। কিন্তু এক বছর পার হলেও টাকা না পেয়ে কী করবেন ভেবে এখন তিনি দিশাহারা।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক ও এনজিও কর্মী ফারহানা বহ্নী জানান, তিনি অ্যাকশনএইডের একটি প্রকল্পে কাজ করেছেন। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে তাঁর ও তাঁর টিমের কাজের জন্য টাকা পরিশোধ করেছে এনজিওটি। প্রকল্পের টাকা তাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রেমিট্যান্স আকারে জমা হলেও, উত্তোলন করতে গিয়ে প্রতিবারই শুনতে হচ্ছে ‘টাকা নেই’। এতে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা আর্থিক ও সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চরফ্যাশন শাখার (ভোলা জেলা) গ্রাহক ইমাম হোসেন মিরাজ। ব্যবসার কাজে ব্যবহারের জন্য এখানেই টাকা রাখতেন এবং উত্তোলন করতেন। কিন্তু সরকার পরিবর্তন ও মার্জারের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে ব্যাংকটি গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না। এখন ঘর তৈরি ও নিজের বিয়ের জন্য জরুরি ভিত্তিতে মিরাজের টাকার প্রয়োজন হলেও তুলতে পারছেন না। তাঁর অ্যাকাউন্টে ১২ লাখ টাকা থাকলেও মাসে পাঁচ হাজার টাকার বেশি তুলতে পারেন না তিনি। আর মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তাঁর প্রয়োজন মিটবে না। তিনি জানান, ‘এই ব্যাংকে টাকা রেখে আমি হতাশ। আর বাংলাদেশ ব্যাংক কী করে? সরকার কী করে? এক বছর পার হয়ে গেলে তার পরও কেন ব্যাংকগুলো টাকা দিতে পারছে না? তাহলে কি ব্যাংকে আমাদের (গ্রাহক) টাকা নিরাপদ নয়? যদি এসব ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয় বা দুর্নীতির কবলে পড়ে দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক আছে কিসের জন্য? তারা এত দিন কী করেছে? তাদের দায়িত্বের অবহেলার কারণে আমার মতো হাজার হাজার গ্রাহক টাকা না পেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। অ্যাকাউন্টে ১২ লাখ টাকা থাকার পরও আমি পাঁচ হাজার টাকার বেশি তুলতে পারব না কেন? এটা দিয়ে কি আমার নতুন ঘর তৈরি করা হবে?’
সরেজমিনে চট্টগ্রামের জিইসি মোড়, আগ্রাবাদ, চকবাজার ও খাতুনগঞ্জের শাখাগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, চেক হাতে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছেন গ্রাহকরা। তবে মজার বিষয় হলো, চেকের অঙ্ক বেশি হলে নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। প্রবেশাধিকার শুধু তাঁদেরই, যাঁরা অল্প কিছু টাকা তুলতে এসেছেন। শুধু নগরীতেই নয়, জেলার বিভিন্ন উপজেলা শাখাগুলোতেও ভোগান্তি পৌঁছেছে চরমে।
মাহামুদুল হক নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘৫০ হাজার টাকার চেক দিলে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় পাঁচ হাজার টাকা। আমার ব্যবসা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কর্মীদের বেতন দিতে পারছি না। কারণ ব্যাংকে টাকা থাকা সত্ত্বেও আমি তা তুলতে পারছি না।’
এই সংকট এখন আর শুধু আর্থিক নয়, এটি মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। চিকিৎসা, সন্তানের স্কুলের বেতন কিংবা ব্যবসার জরুরি প্রয়োজনেও টাকা না পেয়ে গ্রাহকদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। অনেক শাখায় গ্রাহক ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতির মতো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউনিয়ন ব্যাংকের এক ব্যবস্থাপক জানান, ‘একটি শাখায় প্রতিদিন মাত্র এক লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে। এই সামান্য টাকা দিয়ে গ্রাহকদের কিভাবে সামাল দেব, তা আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। আমাদের কাছে কোনো বিকল্প নেই, শুধু সহ্য করা ছাড়া।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু ব্যাংকের অনিয়ম, দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং মার্জার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে গ্রাহকের আস্থা ফিরে আসেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, তারা ধাপে ধাপে সমস্যাগুলো সমাধান করছে, তবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে আরো সময় লাগবে। এদিকে টাকা আটকে পড়া গ্রাহকদের অভিযোগ—সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বহীনতায় এক বছর পরও ব্যাংক লেনদেনের স্বাধীনতা ফিরে আসেনি, ফলে ‘ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ কি না’ এই প্রশ্ন এখন জনমনে।
অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দুর্বল হয়ে পড়া একাধিক বেসরকারি ব্যাংককে একীভূত (মার্জার) করার উদ্যোগে কঠোর হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, মুখের কথায় বা অযৌক্তিক আবদারে মার্জার ঠেকানো যাবে না। ক্যামেলস রেটিং, খেলাপি আদায়, এডিআর, ধার পরিশোধসহ যারা ব্যাংকের বিভিন্ন আর্থিক সূচকে দৃশ্যমান উন্নতি ঘটাতে পারবে না, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত করা হবে। ধার করে টিকে থাকা এবং আগের ধারও পরিশোধে ব্যর্থ ব্যাংকগুলোকে আর কোনো তারল্য সহায়তা দেওয়া হবে না। শুধু এই পাঁচ ব্যাংক নয়, আরো ডজন খানেক ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। পদ্মা ব্যাংকসহ রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ও অসুস্থ রাজনীতির শিকার একাধিক ব্যাংকের লাখ লাখ গ্রাহক এখন হয়রানির শিকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্জ হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের মোট আমানত এক লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা এবং বিতরণকৃত ঋণ এক লাখ ৯০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ ঋণ, মোট এক লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা খেলাপি। মূলধনে ঘাটতি ৪৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা, গ্রাহকসংখ্যা ৯২ লাখ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৫ হাজারের বেশি।
মার্জ হতে যাওয়া এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন জানান, এখন এক্সিম ব্যাংক থেকে কোনো গ্রাহক খালি হাতে ফেরত যায় না। আমরা ৫-১০ লাখ টাকাও পেমেন্ট করছি। কিন্তু যেসব করপোরেট গ্রাহক পাঁচ কোটি বা ১০ কোটি টাকা চাচ্ছেন, তাঁদের আমরা বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাখছি।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের দিলকুশা শাখার ম্যানেজার তহুরুল হক জানান, আমাদের ব্যাংকের কিছু শাখায় সমস্যা হলেও দিলকুশা শাখা থেকে কোনো গ্রাহকই ফেরত যান না। প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা গ্রাহক সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছি। যেহেতু সরকার একটি নতুন উদ্যোগ (মার্জার) হাতে নিয়েছে। তাই গ্রাহকের মনে নতুন করে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। তবে এটা বেশি দিন থাকবে না আশা করি।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য এই সংকটকে আরো স্পষ্ট করে তোলে। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক খাতের ৮০ শতাংশ অর্থ নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যা পুনর্গঠনের জন্য ৩৫ বিলিয়ন ডলার লাগবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।’ এই পরিস্থিতিতে ‘ব্যাংকে জমা রাখা টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই’—বাংলাদেশ ব্যাংকের এই বার্তা গ্রাহকদের কাছে রীতিমতো পরিহাস। লাখো গ্রাহকের কষ্টার্জিত সঞ্চয় এখন ব্যাংকের ভেতরে ‘বন্দি’।