২০২৪ সালের ৫ জুন; নাসার দক্ষ নভোচারী সুনীতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোর আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (আইএসএস) উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল বোয়িং স্টারলাইনারে। আর তাদের সময় নির্ধারিত ছিল- মাত্র আট দিন। কিন্তু আকস্মিক তাদের বহনকারী মহাকাশযানে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। ফলে সেখানেই আটকে পড়েন সুনীতারা। তারপর থেকে একাধিকবার তাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু বারবার তা পিছিয়ে গেছে। আট দিনের সফর দীর্ঘায়িত হয়েছে ৯ মাসে। অবশেষে নাসার এই দুই নভোচারী মহাকাশে নয় মাস আটকে থাকার পর পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন। বোয়িং মিশনে, উইলমোর কমান্ডার হিসেবে এবং উইলিয়ামস পাইলট হিসেবে কাজ করেছেন।
মিশন- আট দিনের জন্য নির্ধারিত থাকলেও প্রযুক্তি ত্রুটি একে নয় মাসের বিশাল কর্মযজ্ঞে পরিণত করে। তাদের এই অপ্রত্যাশিত মিশন, মহাকাশ ভ্রমণ মানব ইতিহাসে দীর্ঘতম মহাকাশ মিশনগুলোর একটি। তবে পৃথিবীতে ফিরে আসার পর সুনীতা সম্ভবত আবার মহাকাশের কথা ভাববেন। তিনি সে বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে নিশ্চিত বলে মনে হচ্ছে, যা হবে ভবিষ্যতের দিকে একটি যাত্রা। ফরচুন ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সুনীতা উইলিয়ামস বলেন, ‘চাঁদ থেকে মঙ্গল’- এটাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। নাসার নভোচারী সুনীতা উইলিয়ামসের সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য সম্পাদনা করা হলো।
ফরচুন : প্রথমত, মহাকাশ কেন এবং এখনই কেন?
সুনীতা উইলিয়ামস : মানুষ বরাবরই কৌতূহলী। কেবল মানবদেহ- অন্যান্য জিনিসের মধ্যে অনুসন্ধানে আগ্রহী। আমাদের সবার কৌতূহল আছে; আমরা মূলত এটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করি। যদিও সমাজ এবং আমাদের চারপাশের যা ঘটছে তা দিয়ে হয়তো এই কৌতূহল খানিকটা চাপা পড়ে যায়, তবে আমরা সবাই কৌতূহলী এবং আমরা অনুসন্ধান করতে মরিয়া হয়ে থাকি। যা একটি জাতি হিসেবে এবং মানুষ হিসেবে মহাকাশ সম্পর্কে আমাকে আশা এবং উপলব্ধির অনুভূতি এনে দেয়।
এমন কী আছে যা আমরা এখনো জানতে চাই?
‘আমরা জানতে চাই, মহাবিশ্বে আসলে আমাদের স্থান কোথায়। আপনি যখন পৃথিবীতে থাকেন, তখন আপনি আপনার চারপাশের পরিস্থিতি নিয়ে ভাবেন। তা ছাড়া প্রাত্যহিক কাজ ছাড়াও আপনার মাথায় থাকে যে, আপনাকে ডাঙ্কিন ডোনাটস বা স্টারবাক্সে লাইনে দাঁড়াতে হবে।’ আমরা বর্তমানের ওপর খুব সংকীর্ণভাবে মনোনিবেশ করি। তবে যখন আপনি মহাকাশে যান এবং দেখেন যে এটি কেবল একটি ছোট গ্রহ যেখানে আমরা সবাই মিলেমিশে বাস করি, তখন এটি আরও ভাবিয়ে তোলে। এখানে আমাদের উদ্দেশ্য কী? আমাদের গ্রহের কী হয়েছিল এবং এমনকি আমাদের গ্রহের এখন কী হচ্ছে?
মঙ্গল (মার্স) কী সেখানে ভূমিকা রাখে?
আমরা যদি সেখানে যেতাম, তবে এখানে শেষ পর্যন্ত কী ঘটতে চলেছে সে সম্পর্কে আমরা কিছু অন্তর্দৃষ্টি পেতেও পারি। আমরা কীভাবে আমাদের গ্রহকে ভালো রাখব এবং অন্যান্য প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া যেতে পারে। আসলে মহাকাশ আমাদের দিগন্তকে আরও কিছুটা প্রসারিত করে। ভাবায়...
এটি কি চাঁদে ফেরার মাধ্যমে শুরু হয়?
আমি জানি না আমরা কীভাবে মঙ্গলে যাব। আমি মনে করি না কেউ এটি সঠিকভাবে জানে। তবে চাঁদে আবারও পদার্পণ এবং (তারপর) মঙ্গলে যাওয়ার চেষ্টার প্রক্রিয়াতে আমরা অবশ্যই নতুন কিছু শিখতে যাচ্ছি। আমরা শারীরিকভাবে-প্রকৌশলী-কীভাবে এই কাজগুলো করতে হয় সে সম্পর্কে অনেক কিছু শিখতে পারব, তবে আমরা মানুষ হিসেবে নিজেদের সম্পর্কে এবং কীভাবে আমরা সমস্যার মোকাবিলা করি এবং কীভাবে আমরা অন্যান্য দেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে ভবিষ্যতে সমস্যার মুখোমুখি হই সে সম্পর্কেও আরও তথ্য জানব।
তাহলে এটি দেখতে কেমন?
‘চাঁদ থেকে মঙ্গল’- এটাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা চাঁদে সফলভাবে ফিরে যেতে চাই, তার মানে সেখানে আমাদের একটি ল্যান্ডারও থাকা দরকার। সম্ভবত সেখানে আমাদের একটি স্পেস স্টেশনও (মহাকাশ স্টেশন) থাকা দরকার, যাকে আমরা চাঁদের গেটওয়ে এবং চাঁদ থেকে লাফিয়ে যাওয়ার স্থান হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। যেখানে আমরা আমাদের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালাব, যেন আমরা চাঁদে সফলভাবে কিছু তৈরি করতে পারি। যখন আমরা ল্যান্ডার এবং মহাকাশযান; এই সমস্ত জিনিস সম্পর্কে চিন্তা করি তখন এটি কিছুটা সায়েন্স ফিকশনের মতো (পাগলামি) মনে হয়। তবে আমি যখন প্রথম নাসার ভবনে আসি, তখন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনকেও (আইএসএস) উদ্ভট ধারণা মনে হয়েছিল। এখন আমি তা করেছি। আসলে মানুষের মন যা করতে পারে, এর বাইরে আমিও নই।
কখন আমরা চাঁদে এবং তারপর মঙ্গলে একটি স্টেশন স্থাপন করব?
এটি দ্রুত কোনো বিষয় নয়। আমি মনে করি, এ দশকেই চাঁদে মানুষ থাকবে এবং ধারণাটি হবে আমরা যত দ্রুত এটি শুরু করতে পারব, আমরা চাঁদে ততটা সফল উপস্থিতি জানান দিতে পারব। আমরা সেখানে মানব বসতি গড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারব এটি করা কতটা কঠিন। মনে রাখবেন, আমরা অ্যাপোলো প্রোগ্রামের জন্য যেখানে গিয়েছিলাম সেখানে যাচ্ছি না। এটি কিছুটা জটিল। আমরা মেরুতে আছি, তাই এটি একটি ভিন্ন কক্ষপথ। এটি একটি ভিন্ন পরিবেশ।
চাঁদে যাওয়া কি সাধারণ ঘটনা হবে?
আমাদের ধারণা নিয়মিতভাবে মানুষকে চাঁদে নিয়ে যাওয়া এবং সেখানে আমাদের স্পেস স্টেশনও তৈরি করা। আর সেটি হবে আমরা কীভাবে মানুষকে মঙ্গল গ্রহে নিয়ে যেতে পারি তা বোঝার জন্য একটি অনুশীলনের ক্ষেত্র, আমরা নিম্ন পৃথিবী কক্ষপথে (আইএসএসের মতো) যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি। আমরা জানি কীভাবে এটি করতে হয়। এটি রকেট, এটি বিপজ্জনক। তবে আমরা জানি কীভাবে করতে হয়। কোম্পানিগুলোকে নিয়মিত এটি করতে দিন। যেন অনুসন্ধানের পরবর্তী ধাপ এগোতে পারি।
কোম্পানিগুলোর কথা বললে মহাকাশ ভ্রমণ এবং বেসরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ অনেক বেড়েছে। এটি কি এসবের মধ্যে একটি কারণ?
আমরা নাসাতে স্পেস ট্যুরিজমের মাধ্যমে এর স্বাদ পেয়েছি, যখন রাশিয়ানরা কিছু পর্যটককে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নিয়ে এসেছিল। আমরা একে গ্রহণ করেছি এবং এর সঙ্গে এগিয়ে গেছি এবং আমরা বুঝতে শুরু করেছি যে, বাণিজ্যিকীকরণের জন্য এখানে একটি পথও রয়েছে। আমরাও তখন বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশ ভ্রমণের জন্য চুক্তি করছিলাম এবং তারপর আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের জন্য বাণিজ্যিক ক্রু বিকল্পগুলো দেখছিলাম। তাই ২০০০-এর দশকের দিকে এসব ধরনের ফাটল ধরতে শুরু করে। গত দশকে সত্যিই এ কার্যক্রম ব্যাপক গতি পেয়েছে।
জনসাধারণের জন্য কি কোনো সুবিধা আছে?
লোকেরা বুঝতে পেরেছে যে, এটি মহাকাশে জিনিস পাঠানোর একটি আকর্ষণীয় উপায়, সম্ভবত করের ডলারের জন্য কিছুটা সস্তা। তবে বড় এবং ভালো চিন্তাটি হলো, এই লোকদের তাদের ইচ্ছেমতো মহাকাশযান ডিজাইন করতে দিন। তাদের সৃজনশীলতা পথ দেখাক। তারা এমন কিছু করতে পারে এবং সম্ভবত আমরা যেভাবে সবসময় করেছি সেভাবে বাধাগ্রস্ত নাও হতে পারে, কারণ সময় পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি হয়েছে, বড় আকারে ধাতুর থ্রিডি প্রিন্টিং, ঘর্ষণ আলোড়ন ওয়েল্ডিং এ ধরনের অন্যান্য প্রক্রিয়া।
এবং কম্পিউটিং শক্তিও?
এটি আশ্চর্যজনক যে, একটি ফোনে ঠিক কতটা কম্পিউটিং শক্তি থাকতে পারে, উদাহরণস্বরূপ- স্পেস শাটলের কম্পিউটারের চেয়ে অনেক বেশি। এ সমস্ত ধরনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, উপকরণ, রাসায়নিক, রকেট ইঞ্জিনের জন্য জ্বালানি ব্যবহারের নতুন ধারণা- বাণিজ্যিক দিকটি উন্মুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্ত কিছু উন্মুক্ত হয়েছে। আসুন লোকদের সৃজনশীল হতে এবং এটি আরও ভালো ও স্মার্টভাবে করা যায়। অবশ্যই, এটি ব্যয়বহুল।
মহাকাশ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আমরা কোন প্রধান ক্ষেত্রগুলোতে ভবিষ্যতে আরও বেশি দেখতে পারি?
অবশ্যই রকেট। তবে উপকরণ, স্যুট, ল্যান্ডারও। আপনি যদি কোনো মানুষকে কোথাও রাখেন, তবে দীর্ঘ সময়ের জন্য সেখানে যাওয়ার জন্য সেই ব্যক্তিকে প্রতিটি দিককে মানিয়ে নিতে হবে। তন্মধ্যে খাদ্য, ব্যায়াম, পোশাক- ছোট ছোট মৌলিক জিনিসগুলো অন্যতম। এজন্য আমাদের সৃজনশীল উপায় বের করতে হবে। যখনই আমি কোনো বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলি এবং তাদের ক্যারিয়ার সম্পর্কে জানতে চাই, তারা কী ভাবছে! এ ক্ষেত্রে আমার ভাবনা- ‘আপনি যা কিছু করেন এবং মহাকাশ ব্যবসায় থাকতে পারেন।’ এতে আপনাকে নভোচারী, প্রকৌশলী বা ডাক্তারও হতে হবে না।
আমরা এখনো অনেক কিছু জানি না।
আমরা (মহাকাশ থেকে) ফিরে আসতে ও শারীরিকভাবে ঠিক থাকতে সক্ষম হয়েছি। তবে যদি দেখতে চান যে, লোকেরা দীর্ঘ সময় মহাকাশে বসবাস করলে তারা কেমন করবে। চাঁদ খুব দূরে নয়, তবে সেই মিশনটি কয়েক সপ্তাহ দীর্ঘ হবে। এতে তারা মাইক্রোগ্রাভিটিতে থাকবে। এর চেয়ে আরও দূরে- মঙ্গলে যাওয়া দীর্ঘ যাত্রা হবে। সময় নেবে! এতে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ থাকবে না। তাই আমাদের শিখতে হবে। বের হতে হবে।
তথ্যসূত্র : ফরচুন