শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. হিমাদ্রী শেখর রায়ের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির (প্লেজিয়ারিজম) অভিযোগ উঠেছে। তিনি তার একটি গবেষণা প্রবন্ধে পূর্বে প্রকাশিত অনুরূপ লেখার বড় একটি অংশ হুবহু বা সামান্য পরিবর্তন করে উপস্থাপন করেছেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও অনুবাদক ড. নিয়াজ জামান প্রকাশিত ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: এ সেঞ্চুরি ট্রিবিউট’ বইয়ে ‘The Portrayal of Submissive and Rebellious Rural Bengali Women in Syed Waliullah’s Tree Without Roots’ শিরোনামে ২০২২ সালে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে এর আগে একই বিষয়ের উপর ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। 'ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ এন্ড লিটারেচার স্টাডিজ' জার্নালে The Projection of Submissive and Revolutionary Women in Syed Waliullah’s Tree Without Roots: A Critical Study’ শিরোনামে এ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।
ওই দুই গবেষণা প্রবন্ধে প্রায় ৯০ শতাংশ এর উপর চৌর্যবৃত্তি আছে বলে অভিযোগ উঠেছে। উভয় প্রবন্ধেই সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর 'লালসালু' উপন্যাসে গ্রামীণ নারীদের চরিত্র বিশ্লেষণে প্রায় একই বক্তব্য, উদ্ধৃতি ও উপস্থাপনা দেখা যায়। যেখানে সহকারী লেখক হিসেবে ছিলেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক রাশেদ মাহমুদ ও ইব্রাহিম খলিল।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক বলছেন, এ ধরনের উচ্চমাত্রার মিল একে চৌর্যবৃত্তির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে গণ্য করে। যদি দুটি কাজ পৃথকভাবে উপস্থাপিত হয় এবং একে অপরকে সঠিকভাবে উল্লেখ না করা হয়, তবে তা অ্যাকাডেমিক নীতিমালার গুরুতর লঙ্ঘন। একজন অধ্যাপকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ গবেষণা এবং শিক্ষার পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলেও জানান তারা।
এদিকে বিভাগে প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় নিয়মবহির্ভূত এমফিল ডিগ্রির অনুমোদনসহ তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর তিনি বেআইনিভাবে প্রশাসনের এবং বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বিভাগের অফিস থেকে গোপনে সকল সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করেছেন বলেও জনা গেছে। শিক্ষার্থীরা ধারণা করছেন আওয়ামীপন্থি এ শিক্ষকের গোপনে সংগ্রহ করা এসব তথ্য তিনি গোয়েন্দাসংস্থা বা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অন্য কোন কাজে ব্যবহার করে থাকতে পারেন।
একাধিক বিভাগের প্রধানের সাথে কথা বললে তারা জানান, এসব তথ্য নিতে গেলে কমপক্ষে বিভাগের প্রধানের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি ছাড়া কেউ এসব তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন না। হিমাদ্রী শেখর রায় এসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন আমরা সেটা পরে জানতে পেরেছি এবং অফিস সহকারীদের অনুমতি ছাড়া এসব তথ্য কেন দিয়েছেন এসব কারণও জানতে চেয়েছি অফিসিয়ালি। তবে এ বিষয়ে ড. হিমাদ্রী শেখর রায় বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজে তথ্য সংগ্রহ করে তাকি। এতে দোষের কিছু নেই।’
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া এসব তথ্য নেবার কোন সুযোগ নেই। এছাড়াও এগুলো অত্যন্ত গোপনীয় বিষয়। এসব তথ্য নিয়ে বিভিন্ন কাজে লাগাতে পারে তারা, যেখানে শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে যেকোনো বিপদে পড়তে পারে। এগুলো খুবই সেনসিটিভ বিষয়। এসব তথ্য সংগ্রহ করতে হলে প্রশাসনের অনুমতি অবশ্যই প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক শরীফা ইয়াসমিনকে একাধিকবার ফোন দিলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘পূর্বে কোনো জার্নালে প্রকাশিত লেখা আবারও অন্য কোথাও দেওয়া ইথিক্যাল জায়গা থেকে উচিত না এবং এটা কাউন্ট করাও ঠিক না।’
এসব বিষয়ে মুঠোফোনে অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. হিমাদ্রী শেখর রায় বলেন, ‘এ ব্যাপারে প্রথম লেখক (ইব্রাহীম খলিল) যিনি আছেন তিনি ভালো বলতে পারবেন। আর এতে কোন দোষ নেই। আমার লেখা আমি যেকোন জায়গায় ব্যবহার করতেই পারি। এটাকে চুরি বলে না। অধ্যাপক নিয়াজ জামানের বইয়ে অনুমতি নিয়ে আর্টিকেল দেওয়া হয়েছে। উনার কাছে সকল ডকুমেন্টস দেয়া আছে।’
তবে বিষয়টি অস্বীকার করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, লেখক ও অনুবাদক অধ্যাপক ড. নিয়াজ জামান। তিনি বলেন, ‘এটাতো খুবই সিরিয়ায় অভিযোগ। আমি তো এ বিষয়ে কিছুই জানতাম না। আর এটাতো আমার পক্ষে জানা সম্ভবও না। যে-সব পেপার আগে প্রকাশিত হয়েছে এসব আর দ্বিতীয়বার ক্রেডিট ছাড়া প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ নেই। এটা যে পূর্বে প্রকাশিত হয়েছে সেটাও উল্লেখ করা হয়নি। আমার ওই জার্নালে আরো পেপার আছে পূর্বে প্রকাশিত। এগুলো সেখানে উল্লেখও করা হয়েছে। কিন্তু এটার বিষয়ে আমাকে কিছু জানানো হয়নি। অমি অত্যন্ত দুঃখিত যে এটা আমি জানতাম না বা আমাকে জানানো হয়নি। আমি কথা বলবো এটা নিয়ে।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সাজেদুল করিম বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া রাষ্ট্রপতিরও নিয়ম নেই শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করা। এটা কোনোভাবেই উচিত না, না জানিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার।' গবেষণা প্রবন্ধের ব্যাপারে জানত চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু আগে আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নালে লেখাটি প্রকাশ করা হয়েছে তাই আবার অন্য একটি প্রবন্ধে প্রকাশ করলে সেটি উল্লেখ করা উচিত। উল্লেখ না করে প্রকাশ করা উচিত না।’
বিডি প্রতিদিন/হিমেল