বাংলাদেশের রক্ষণভাগে আস্থার প্রতীক তপু বর্মণ ধীরে ধীরে মাঠে এলেন। অভিভূত হয়ে পড়লেন তিনি। ২২ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার জাতীয় স্টেডিয়ামে তখন শূন্য আসনের সংখ্যা খুব বেশি নয়। অথচ ম্যাচ শুরু হওয়ার ঢের বাকি। দুই ঘণ্টা। এমনকি ম্যাচপূর্ব ওয়ার্ম-আপের সময়ও হয়নি। তপুরা মাঠে আসেন গ্যালারির দৃশ্যটা উপভোগ করতে। স্মৃতি হিসেবে রেখে দিতে মোবাইলের ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ করলেন তপু। ফাহামিদুলদের নিয়ে সেলফি তুললেন রাকিব। হাজারো দর্শকদের এমন ভিড় সাম্প্রতিক ফুটবলে আর কবেই বা দেখা গেছে!
ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারি পূর্ণ। মাঠে ওয়ার্ম-আপ সেরে নিয়েছেন হামজা-সামিত-ফাহামিদুল-তপুরা। এবার আসল লড়াই। গত মার্চে হামজা চৌধুরী ভারতের শিলংয়ে এক নতুন বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। তার ট্যাকল, ড্রিবলিং, ব্লক দেখে মুগ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষও স্বীকার করেছিল বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠত্ব। নতুন পথে চলার আরও এক ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। এবার উইংয়ে দেখা গেল ফাহামিদুল-সামিতের গতির ঝলক। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডে হামজা নিজের কাজ দেখালেন। ম্যাচের বিল্ড-আপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেন। ডিফেন্স ও ফরোয়ার্ড লাইনের মাঝে যোগসূত্র স্থাপন করলেন। প্রবাসী ফুটবলারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলেছেন স্থানীয়রাও। তবে বরাবরের মতোই স্ট্রাইকারের অভাব দেখা গেছে ম্যাচজুড়ে। রাকিব বেশ কয়েকবার ব্যর্থ হয়েছেন সামিত-ফাহামিদুলদের পাস ধরে বল জালে জড়াতে। বারবার অফসাইডের ফাঁদে পড়েছেন তিনি।
ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রায় সাড়ে ৪ বছর পর আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়েছে। ভুটান ম্যাচেই দর্শকরা নিজেদের সরব উপস্থিতি জানান দিয়েছিলেন। গতকালের উপস্থিতি ছিল বহুগুণে বেশি। ফুটবলে নতুন পথে চলার সূচনালগ্নে দর্শকরাই প্রাণ হয়ে রইলেন। তবে হামজা-সামিত-ফাহামিদুলরা দারুণ এক সম্ভাবনা জাগিয়ে দিয়েছেন। নতুন খেলার ধরন দেখেছেন দর্শকরা। জয়-পরাজয়ে ভয়হীন হয়ে খেলার উদাহরণ তৈরি করেছেন। তবে নতুন ধরনের খেলায়ও সেই পুরোনো ফল। পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ।
বাংলাদেশের স্প্যানিশ কোচ হাভিয়ের কাবরেরা বড় মুখ করে বলেছিলেন, সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে জিতবে বাংলাদেশ। তার বিশ্বাস রাখতে পারলেন না হামজারা। ম্যাচের প্রথমার্ধে ৭ নম্বর জার্সিধারী সঙ এবং দ্বিতীয়ার্ধে ৯ নম্বর জার্সিধারী ইখসান ফেন্দির গোলে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে সিঙ্গাপুর। রাকিব ৬৭ মিনিটে গোল করেও দলের পরাজয় রুখতে পারেননি। তবে শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশ দারুণ কিছু আক্রমণ করেছে। হামজা-মোরসালিন-ফাহিম-সামিতরা সাঁড়াশি আক্রমণে ভেঙে দিয়েছেন সিঙ্গাপুরের ডিফেন্স লাইন। কিন্তু গোলের দেখা পায়নি বাংলাদেশ। ড্রও করতে পারেননি হামজারা।
এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচের টিকিট বিক্রি হয় অনলাইনে। কয়েক দিন ধরে চেষ্টা করেও অনেকেই টিকিট পাননি। যারা ফুটবলের দুর্দিনেও পাশে ছিলেন, তারাও বঞ্চিত। ক্লাবগুলোর জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্দও ছিল না। টিকিট না পেয়ে ক্ষোভ-দুঃখ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। ভুটানের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে টিকিটহীন অনেকেই বেরিকেড ভেঙে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করেছিলেন। তবে গতকাল ছিল কড়া নিরাপত্তা। ফুটবলে নতুন রূপে পুরোনো দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়েছে।
এটা যেমন ভালো দিক, তেমনি অভিমানী দর্শকের কথাও মনে রাখা প্রয়োজন। ফুটবলে ভালো সময় এসেছে বলেই এলিটদের নজর পড়েছে। ভালো সময় চলে গেলে এলিটরা কি ফুটবলের দিকে ফিরে তাকাবেন? গত দেড় যুগ ধরে তাদের ফুটবলের কাছে পাওয়া যায়নি। এই সময়টায় পোড় খাওয়া অতি সাধারণরাই ছিলেন নিবু-নিবু ফুটবলের প্রাণ। তাদের অনেকেই গতকাল ছিলেন অনুপস্থিত। হয়তো এ কারণেই প্রথমার্ধের শেষ মুহূর্তে গোল হজম করায় অনেকেই বাড়ির পথ ধরেছিলেন! এক দর্শক তো বলেই দিলেন-মনটাই ভেঙে গেল। মনভাঙা এসব দর্শক ফের মাঠে ফিরবেন কি! অবশ্য ম্যাচ শেষ হওয়ার পরও মাঠে অনেক দর্শক ছিল। ম্যাচ শেষে ২-১ গোলে দল হারলেও হামজাদের খেলায় মুগ্ধ হয়েছেন তারা। ম্যাচ শেষে হামজাদের অভিবাদন জানিয়েই বাড়ি ফিরেছেন ফুটবলপ্রেমীরা।