দেশের শিল্প-বাণিজ্য প্রসারে এক অনুপ্রেরণার নাম স্যামসন এইচ. চৌধুরী। গড়ে তুলেছেন ‘স্কয়ার’ নামক বিশাল এক মহীরুহ। ১৯২৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের আড়ুয়াকান্দিতে জন্ম তাঁর। আজ তাঁর জন্মশতবার্ষিকী। তাঁর বাবা ছিলেন চিকিৎসক। ১৯৪৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করে তিনিও বাবার মতো ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা, বিশেষ করে অনুজ চার ভাই ও দুই বোনের লেখাপড়া ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তা সম্ভব হয়নি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি পাড়ি জমান মুম্বাইয়ে। সেখানে যোগ দেন রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভিতে। তিনি সিগন্যালিং শাখায় চাকরি না নিয়ে রাডার অপারেটর হওয়ার জন্য চার দিন কারাবরণ করেন। এক পর্যায়ে তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে কর্তৃপক্ষ হার মানে। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে আসেন। পাবনার ডাক বিভাগে যোগদান করেন। তিনি আরও বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন। বাবার পরামর্শে ‘হোসেন ফার্মেসি’র দায়িত্ব নেন। ছেড়ে দেন ডাক বিভাগের চাকরি। ‘হোসেন ফার্মেসি’ তাঁর উদ্যোক্তা জীবনের প্রথম সোপান। ১৯৫৬ সালে মাত্র ৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে তিনি নিজ বাড়িতেই একটি ছোট ওষুধ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। নাম দিলেন ‘ইসনস্’ ((Esons)। একমাত্র সহকারী হিসেবে পেলেন তাঁর কর্মজীবনের সহযোদ্ধা স্ত্রী মিসেস অনিতা চৌধুরীকে। ১৯৫৮ সালে তিনি তিন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্কয়ার’। এ নামের পেছনে ছিল এক গভীর দর্শন। ‘স্কয়ার’-এর চারটি বাহু যেমন- চার বন্ধুকে বোঝাত, তেমনি এটি ছিল পরিপূর্ণতা ও শুদ্ধতার প্রতীক। তাঁর বিখ্যাত উক্তি ‘সাফল্য অর্জনে কোনো শর্টকাট পথ নেই’- এ মন্ত্রকে তিনি সব সময় পাথেয় করেছেন। প্রথম তিন বছর কোনো লাভ না হলেও তাঁর অবিচল সাধনা স্কয়ারকে নিয়ে যায় সাফল্যের শিখরে। ১৯৮৫ সালে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস দেশসেরা হয়ে ওঠে। সেই অবস্থান আজও ধরে রেখেছেন তাঁরা। স্কয়ার ফার্মার ওষুধ ছাড়াও দেশের সীমা ছাড়িয়ে স্কয়ারের অন্য পণ্যগুলোও এখন বাজারজাত হচ্ছে দেশের বাইরে। ওষুধ শিল্পে সাফল্যের পর স্যামসন এইচ. চৌধুরী তাঁর প্রতিষ্ঠানকে আরও সম্প্রসারিত করেন। ১৯৮৮ সালে স্কয়ার টয়লেট্রিজ, ১৯৯৪ সালে স্কয়ার টেক্সটাইলস, ১৯৯৭ সালে মিডিয়াকম লিমিটেড, ১৯৯৮ সালে এগ্রো-কেমিক্যালস ও ভেটেরিনারি প্রোডাক্টস, ২০০০ সালে স্কয়ার স্পিনিং এবং ২০০১ সালে স্কয়ার নিট ফ্যাব্রিক্স, স্কয়ার ফ্যাশনস, স্কয়ার কনজিউমার প্রোডাক্টস, স্কয়ার ইনফরম্যাটিক্স ও স্কয়ার হসপিটালস লিমিটেড এবং ২০১১ সালে মাছরাঙা টেলিভিশন যাত্রা শুরু করে।

এভাবে একের পর এক নতুন উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি দেশের শিল্প খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। সমাজের প্রতিটি স্তরে, বিশেষ করে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে তিনি মুক্তহস্তে দান করতেন। স্যামসন এইচ. চৌধুরীর সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো- তাঁর ভিশন ও আদর্শকে তাঁর উত্তরসূরিদের মধ্যে প্রবাহিত করতে পারা। তাঁর সন্তানদের নেতৃত্বে স্কয়ার গ্রুপ শুধু ওষুধ শিল্পে নিজেদের শীর্ষস্থান ধরে রাখেনি, বরং তাঁর দূরদর্শিতার ধারাবাহিকতায় একের পর এক নতুন খাতে নিজেদের প্রসারিত করেছে। স্কয়ার হসপিটালসের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনে তাঁর মানবসেবার যে ব্রত কাজ করেছে, তাঁর উত্তরসূরিরাও সেই একই আদর্শে সেবার মান নিশ্চিত করে চলেছেন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি ৮৬ বছর বয়সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই ক্ষণজন্মা মানুষটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৭ জানুয়ারি মৃত্যুর দুই দিন পর পাবনায় তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ ও মূল্যবোধের পথ ধরেই তাঁর উত্তরসূরিরা এগিয়ে চলেছেন, এগিয়ে চলেছেন স্কয়ার পরিবারের ৮১ হাজার সদস্য।