শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী জয়ন্তী রায়। বয়স ৪০। পারিবারিক অসচ্ছলতার মধ্যেই এসএসসির গণ্ডি পেরিয়েছেন। কিন্তু অভাবের তাড়নায় আর কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। কৃষক হরিচান রায়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। অভাবের সংসার। এক ছেলেকে নিয়ে জয়ন্তী-হরিচান দম্পতির সংসার। একটু ভালো থাকার আশায় বাড়ির উঠানে গাছতলায় ১০ শিশুকে নিয়ে পাঠশালা খোলেন জয়ন্তী। শিক্ষার্থীরা মাসে ৩০০ টাকা করে বেতন দিতেন। ঝড়-বৃষ্টি এলেই গাছতলা থেকে শিশুদের নিয়ে আশ্রয় নিতেন পার্শ্ববর্তী মন্দিরে। প্রতিবন্ধী নারীর এ পাঠশালার দুর্ভোগের কথা জানতে পারে উপজেলা প্রশাসন। শিশুদের পড়ানোর জন্য টিনশেড নির্মাণ ও শিক্ষক জয়ন্তীর জন্য প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা বেতনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এখন পাঠশালা চালিয়ে সরকারি বেতন পাচ্ছেন এ প্রতিবন্ধী নারী। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের বন্যাবাড়ি গ্রামের জয়ন্তীর গল্প এটি। বর্তমানে তার বিদ্যালয়ে ৩০ জন শিশু পড়াশোনা করছে। ওই গ্রামের শর্বরী বিশ্বাস ও মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল বলেন, ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী জয়ন্তী। তার স্বামী হরিচান রায় নিজেদের জমিতে সারা বছর কৃষিকাজ করেন। সেই আয় দিয়েই কোনোরকমে চলে তাদের অভাবের সংসার। অর্থনৈতিক মুক্তির আশায় গ্রামের শিশুদের নিয়ে পাঠশালা খোলেন জয়ন্তী। সেসময় ১০ শিশুকে পড়িয়ে মাসে ৩ হাজার টাকা নিতেন। এলাকার মানুষ দরিদ্র। কেউ কেউ ৩০০ টাকা, আবার অনেকে ৫০, ১০০, ২০০ টাকাও দিতেন। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে বন্যাবাড়ি গ্রামের একটি রাস্তার কাজ পরিদর্শনে আসেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মঈনুল হক। তারপর থেকেই শিক্ষার্থীদের পড়ানো বাবদ কোনো টাকা দিতে হতো না জয়ন্তীকে। জয়ন্তী রায় বলেন, ‘হঠাৎ এক দিন ইউএনও স্যার গাছতলার পাঠশালায় চলে আসেন। তখন এলাকার শিশুদের পড়িয়ে মাসিক ৩০০ টাকা নিই জানতে পারেন। পরে তিনি অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকা নিতে নিষেধ করেন। মাস শেষে উপজেলায় গিয়ে ১০ জন শিক্ষার্থীকে পড়ানোর পারিশ্রমিক বাবদ ৩ হাজার টাকা তার (ইউএনও) কাছ থেকে আনতে বলেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার টাকা করে ইউএনও স্যারের কাছ থেকে নিয়ে আসতাম। আর ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে মন্দিরভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আমার পাঠশালা অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এখন ওই কার্যক্রমের আওতায় মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছি। এ ছাড়া মার্চ মাসে ইউএনও স্যার একটি টিনশেড ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখন বাড়িতে পাঠশালা চালিয়ে সরকারি বেতন পাচ্ছি। এলাকার শিশুদের অক্ষর সংক্রান্ত জ্ঞান বিনা পয়সায় আজীবন দিয়ে যাব। আর আমার মতো শারীরিক প্রতিবন্ধীকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করায় সরকার ও উপজেলা প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’ শিক্ষার্থীর অভিভাবক বন্যাবাড়ি গ্রামের শিউলি বিশ্বাস ও সবিতা রায় বলেন, ‘সংসারের অভাব-অনটন ঘোচাতে জয়ন্তী বাড়ির উঠানে গাছের নিচে পাঠশালা শুরু করেন। রোদ-বৃষ্টিতে আমাদের ছেলেমেয়েরা কষ্ট পেত। বৃষ্টি এলেই পার্শ্ববর্তী মন্দিরে আশ্রয় নিত তারা। আমরা দরিদ্র। তাই সবাই ঠিকমতো জয়ন্তীকে পড়ানোর টাকা দিতে পারতাম না। ইউএনও স্যার একটি ঘর ও জয়ন্তীর পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখন বিনা টাকায় এখানে আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে।’ টুঙ্গিপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মঈনুল হক বলেন, ‘বন্যাবাড়ি গ্রামের শিশুদের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির (টিআর) আওতায় ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি টিনশেড পাঠশালা নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে গত জানুয়ারি থেকে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের মন্দিরভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় পাঠশালার শিক্ষক জয়ন্তী রায়ের বেতনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পাঠশালায় বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়ার পর শিশুদের গরমের দুর্ভোগ কমাতে প্রশাসন থেকে তিনটি পাখার ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়েছে। জনকল্যাণে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।